আজকাল ওয়েবডেস্ক: আজ, ২৫ জুন ২০২৫—ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়ের পঞ্চাশতম বর্ষপূর্তি। ১৯৭৫ সালের এই দিনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষিত করেছিলেন দেশের প্রথম ও একমাত্র জরুরি অবস্থা, যা ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত চলেছিল। যদিও সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই এই ঘোষণা এসেছিল, তা গণতন্ত্রের আদর্শ এবং মৌলিক অধিকারগুলোর নির্লজ্জ লঙ্ঘন ছিল।
জরুরি অবস্থার পটভূমি ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতায় পরিপূর্ণ। ১৯৭১ সালের লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর জয়কে অ্যালাহাবাদ হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করায় তার রাজনৈতিক ভিত্তি নড়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে, দেশে চলছিল বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি ও ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলনের ঢেউ। এই সংকট মোকাবিলায়, সরকার যা করেছিল তা ছিল সংবিধানবিরোধী এক কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ।
কিন্তু ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে জনগণ এর জবাব দিয়েছিল স্পষ্টভাবে—ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে পুনরায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু আজ, পঞ্চাশ বছর পর, ভারতে আরেক ধরনের সংকট ঘনিয়ে এসেছে—একটি ‘ঘোষিত নয় এমন জরুরি অবস্থা’। এর কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নেই, নেই সেনা ট্যাঙ্ক কিংবা কারফিউ, কিন্তু রয়েছে ধাপে ধাপে সংবিধানের মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয়।
আজকের ভারতে গণতান্ত্রিক অবক্ষয়
Freedom House-এর ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে ভারতকে “আংশিক মুক্ত” এবং V-Dem-এর মতে “নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র” হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির উত্থানের পর থেকে এই গণতান্ত্রিক অবক্ষয় স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সংখ্যালঘু নিপীড়ন, সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ, বিচার ব্যবস্থার স্বায়ত্তশাসন খর্ব, এবং বিরোধীদের উপর রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগের অপব্যবহার—এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে এক নতুন ধরনের কর্তৃত্ববাদের উত্থান ঘটছে, যা ১৯৭৫ সালের মতোই বিপজ্জনক, যদিও অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও কাঠামোগত। ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা ছিল উন্মুক্ত—ঘোষণাসহ কড়া রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া এক আইনসিদ্ধ অথচ নীতিহীন শাসনব্যবস্থা।
‘আইনি স্বৈরতন্ত্র’ ও আজকের ভারত
যুক্তরাষ্ট্রের আইনতাত্ত্বিক কিম লেন শেফ্পেলে 'autocratic legalism' বা 'আইনি স্বৈরতন্ত্র'-এর যে ধারণা দেন, তার সঙ্গে বর্তমান ভারতের অদ্ভুত মিল। সরকার আজ বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে ধাপে ধাপে নিয়ন্ত্রণে আনছে—সবই আইনসম্মত প্রক্রিয়ায়, কিন্তু নৈতিক শূন্যতায় পূর্ণ। ধারা ৩৭০ বাতিল, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA), এবং ইলেকটোরাল বন্ডের মতো উদাহরণগুলি—সবই দেখায় কীভাবে আইন ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে খণ্ডিত করা যায়।
‘ব্যতিক্রমের অবস্থা’ এখন স্বাভাবিক
জার্মান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ কার্ল শমিট বলেছিলেন, “সার্বভৌম হল সেই ব্যক্তি যে ব্যতিক্রমের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।” ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থায় সরকার ব্যতিক্রম ঘোষণা করেছিল। কিন্তু আজকের ভারতে ব্যতিক্রমই নিয়মে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র এখন নিয়মিতভাবে ইউএপিএ, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, ও এনআইএ আইনের মতো অস্ত্র ব্যবহার করে সাংবাদিক, ছাত্র, কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের দমন করছে।
গণতন্ত্রের আত্মা হ্রাসপ্রাপ্ত
সর্বোপরি, এই সময়ের বিপদ শুধু রাজনৈতিক নয়, নৈতিকও। যেমন আইনজীবী ও অধিকারকর্মী অরবিন্দ নারাইন বলেন, “এটি কেবল কর্তৃত্ববাদ নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার উত্থান।” চিন্তাবিদ প্রতাপ ভানু মেহতা মনে করিয়ে দেন, ১৯৫০ সালে ভারত যখন সার্বজনীন ভোটাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান গ্রহণ করেছিল, তখন সেটি ছিল এক ‘আস্থা-ভিত্তিক লাফ’। কিন্তু আজ সেই আস্থা তীব্র সংকটে।
ইতিহাসের শিক্ষা ও নাগরিকের দায়িত্ব
জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পর, আমাদের সবচেয়ে জরুরি কাজ গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করা—তথ্য ও বিতর্কের মাধ্যমে, ক্ষমতার জবাবদিহির মাধ্যমে, এবং সবচেয়ে বেশি, জনসচেতনতার মাধ্যমে। গণতন্ত্র কেবল ভোট নয়, এটি একটি সংস্কৃতি—যেখানে সংবিধান কাগজে নয়, মানুষের মনে বেঁচে থাকে। তাই আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত—নীরবতার মধ্যে না হারিয়ে, ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করে, এক দৃঢ় ও মানবিক গণতন্ত্র গড়ে তোলা।
