আজকাল ওয়েবডেস্ক: গুজরাটের ভদোদরা জেলায় মহিসাগর নদীর উপর নির্মিত মুজপুর-গম্ভীরা সেতু ধসে পড়ার ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০-এ। শুক্রবার সন্ধ্যায় (১১ জুলাই) সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে পিটিআই জানিয়েছে, উদ্ধারকারী দল আরও একটি নিখোঁজ দেহ উদ্ধার করেছে, এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন আহত ব্যক্তি মারা গেছেন।
ভদোদরার কালেক্টর অনিল ধামালিয়া পিটিআই-কে বলেন, “প্রথম দিনে আমরা ১২টি মৃতদেহ উদ্ধার করি এবং দ্বিতীয় দিনে ৬টি। আজ একজন হাসপাতালে মারা গেছেন এবং আমরা আরও একটি দেহ উদ্ধার করেছি।” শনিবার উদ্ধার কাজের পরবর্তী ধাপ প্রসঙ্গে তিনি জানান, নদীতে পড়ে থাকা ভেঙে যাওয়া মূল কংক্রিট স্ল্যাবটি তুলে আনার চেষ্টা করা হবে, প্রযুক্তিগত দলের সহায়তায়। নিখোঁজ তালিকায় থাকা আরেকজনকে খোঁজার চেষ্টা চলবে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন: ভারতীয় নির্বাচন ব্যবস্থার বিচার: সুপ্রিম কোর্ট, বিহার ভোটার তালিকা এবং ভোটাধিকার জন্য সংগ্রাম
বুধবার (৯ জুলাই) ভোররাতে প্রায় ৮৩০ মিটার দীর্ঘ এই সেতুর একটি অংশ ভেঙে পড়ে, যার ফলে বেশ কয়েকটি গাড়ি মহিসাগর নদীতে পড়ে যায়। এই সেতুটি দক্ষিণ গুজরাট ও সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী পথ ছিল। পড়ে যাওয়া যানবাহনের মধ্যে একটি সালফিউরিক অ্যাসিডবাহী ট্যাঙ্কারও রয়েছে, যা এখনও জলে আটকে রয়েছে। শনিবার এই ট্যাঙ্কারটিকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান কালেক্টর।
এর আগে বৃহস্পতিবার কালেক্টর বলেছিলেন, “কাদায় আটকে পড়া ট্রাকগুলো সরানো ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ।” এই ঘটনার জেরে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যের সড়ক ও ভবন দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল চারজন ইঞ্জিনিয়ারকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা হলেন নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার এন.এম. নায়কাওয়ালা, উপ-নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার ইউ.সি. প্যাটেল ও আর.টি. প্যাটেল এবং সহকারী ইঞ্জিনিয়ার জে.ভি. শাহ।
সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, একটি বিশেষজ্ঞ দলের প্রাথমিক তদন্তে এই চারজনের দায়িত্বহীনতা প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী গুজরাটের অন্যান্য সেতুগুলোর জরুরি ও ব্যাপক পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন জনস্বার্থে। এই সেতু বিপর্যয় রাজ্যে পরিকাঠামোর দুর্বলতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। জানা গেছে, মহিসাগর সেতুর দুর্বল অবস্থার বিষয়ে ২০২২ সালেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য হর্ষদসিং পরমার ওই বছর এক চিঠিতে সেতুর ভগ্নাবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
একই সময়ে ভাইরাল একটি অডিও ক্লিপে, কর্মী লক্ষণ দরবারকে সেতুর অবস্থা নিয়ে একজন রাস্তা ও ভবন বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে শোনা যায়, যেখানে ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে সেতুর অবস্থা ভালো নয়। তবু নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার নায়কাওয়ালা বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “সেতুর পরিদর্শনে কোনও বড় ধ্বংস বা ক্ষতির চিহ্ন পাওয়া যায়নি।” এই ঘটনা রাজ্যে বিগত কয়েক বছরে ধারাবাহিক সেতু দুর্ঘটনার মধ্যে আরও একটি সংযোজন। ২০২২ সালের অক্টোবরে গুজরাটের মোরবিতে একটি ঝুলন্ত সেতু ধসে ১৪১ জনের মৃত্যু হয়েছিল—যা এখনো জনমনে গভীর দাগ রেখে গেছে।
বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর দাবি উঠছে নানা মহল থেকে। সাধারণ মানুষ সরকারের দীর্ঘস্থায়ী অবহেলা ও ঘাটতি পূরণের দাবি তুলেছে। অথচ পূর্ব সতর্কতার পরেও কেন সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের আওতায় আনা হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয়রা ও বিশ্লেষকরা। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, রাজ্যের পরিকাঠামো খাতে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও অনেক পুরনো সেতু এবং রাস্তাঘাট অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
সরকারি নজরদারির অভাব, নিয়মিত তদারকির ঘাটতি এবং মেরামতের কাজে দুর্নীতি—এই তিন মিলেই এমন দুর্ঘটনার আশঙ্কা দীর্ঘদিন ধরেই বেড়েছিল। এদিকে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই ঘটনার জন্য রাজ্য সরকারের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে। কংগ্রেস এবং আপ নেতারা দাবি করেছেন, “মোরবির ঘটনার পরও রাজ্য সরকার শিক্ষা নেয়নি। একই ধরনের গাফিলতি ফের প্রাণ কাড়ল।”
মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও বলছেন, শুধু দোষীদের বরখাস্ত করলেই চলবে না—একটি স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি, রাজ্যের সব সেতুর অবস্থা যাচাই করে প্রয়োজনে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করা জরুরি। বর্তমানে উদ্ধার অভিযান চতুর্থ দিনে প্রবেশ করেছে এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যতদিন না পর্যন্ত সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায় এবং আটকে পড়া যানবাহন সরানো হয়, ততদিন উদ্ধার অভিযান চলবে।
রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (SDRF), জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (NDRF), দমকল এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা যৌথভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সার্বিকভাবে, এই দুর্ঘটনা শুধুমাত্র একটি সেতু ভাঙনের ঘটনা নয়, বরং রাজ্যে পরিকাঠামোগত নিরাপত্তা, দায়িত্বশীলতা এবং প্রশাসনিক নজরদারির অভাবকে নতুন করে সামনে এনে দিয়েছে।
