আজকাল ওয়েবডেস্ক: কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত "Viksit Bharat–Guarantee for Rozgar and Ajeevika Mission (Gramin) Bill, 2025"কে ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্ক তীব্র হচ্ছে। বিজেপি ছাড়া প্রায় সমস্ত শ্রমিক সংগঠন, বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের একাংশের অভিযোগ, এই বিল কার্যত মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন (MGNREGA), ২০০৫–এর মৌলিক দর্শনকেই বদলে দিতে চলেছে। কংগ্রেস আমলে ২০০৫ সালের আইনে যেখানে গ্রামীণ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কাজের আইনি অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল, নতুন প্রস্তাবিত বিলে সেই অধিকারকে কেন্দ্রের আর্থিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের অধীন একটি প্রকল্পে রূপান্তর করা হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
MGNREGA ছিল একটি কাজের অধিকারের আইন, যার অধীনে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী যে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক কাজ চাইলে ১৫ দিনের মধ্যে তার কাজ পাওয়ার আইনি নিশ্চয়তা ছিল। কাজ না পেলে বেকার ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল আইনে। প্রস্তাবিত "VB-G RAM G" বিলে এই বাধ্যবাধকতা আর থাকছে না। নতুন বিলে শুধুমাত্র কেন্দ্র সরকার নির্ধারিত বা নোটিফাইড এলাকাতেই কাজ পাওয়া যাবে, ফলে সর্বজনীন কর্মসংস্থানের অধিকার কার্যত সীমিত হয়ে যাবে। সমালোচকদের মতে, এতে কর্মসংস্থান আর শ্রমিকের দাবি হিসেবে গণ্য হবে না, বরং সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে প্রতীকী এবং রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হল প্রকল্পের নাম থেকে রাষ্ট্রপিতা মহাত্মা গান্ধীর নাম বাদ দেওয়া। সরকারের তরফে একে স্রেফ নাম বদল হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলেও, বিরোধীদের দাবি এটি একটি আদর্শগত রূপান্তরের ইঙ্গিত। গান্ধীর নাম কেবল একটি প্রতীকী ব্যাপার ছিল না, বরং এই আইনের নৈতিক ভিত্তি ও ঐতিহাসিক স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিল যা গান্ধীর 'সর্বদয়' ভাবনার প্রতিফলন। দরিদ্রতম মানুষের জীবিকা সুরক্ষার যে দর্শনের ওপর MGNREGA দাঁড়িয়ে ছিল, নতুন বিলে সেই ভিত্তিকেই কার্যত মুছে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।
নতুন বিলে বছরে কাজের দিন ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অর্থ বরাদ্দের নতুন কাঠামো কাজের দিন বৃদ্ধিকে কার্যত অর্থহীন করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। MGNREGA-য় শ্রমিকদের চাহিদা অনুযায়ী কেন্দ্র সরকারকে অর্থ দিতে হত এবং শ্রম মজুরির সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রের ওপর। প্রস্তাবিত আইনে কেন্দ্র আগেভাগেই রাজ্য অনুসারে অর্থ বরাদ্দ ঠিক করবে। এই বরাদ্দের বাইরে খরচ হলে তার দায় বহন করতে হবে রাজ্য সরকারকে। এর ফলে আর্থিক চাপে পড়ে অনেক রাজ্য কাজের চাহিদা নথিভুক্ত করতেই পিছিয়ে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্যয়ভার বণ্টনের ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে যেখানে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে কার্যত ৯০:১০ অনুপাত বজায় রয়েছে, সেখানে নতুন বিলে অধিকাংশ রাজ্যের জন্য সেই অনুপাত ৬০:৪০ করা হচ্ছে। দরিদ্র ও গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ওপর বেশি নির্ভরশীল রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মত অর্থনীতিবিদদের।
প্রস্তাবিত বিলে চাষের ব্যস্ত মরসুমে ৬০ দিন পর্যন্ত প্রকল্প স্থগিত রাখার কথাও বলা হয়েছে। সরকারের যুক্তি, এতে কৃষিকাজে শ্রমিকের জোগান বাড়বে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এতে গ্রামীণ পরিবারগুলি সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়ে কাজ হারাবে এবং ফের শোষণমূলক কাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এর পাশাপাশি ডিজিটাল উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব বহু শ্রমিকের জন্য নতুন বাধা তৈরি করতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
MGNREGA-র আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল গ্রামসভা ও পঞ্চায়েতের ভূমিকা। স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ নির্ধারণের এই বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাকে নতুন বিলে 'ন্যাশনাল রুরাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার স্ট্যাক’-এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর ফলে স্থানীয় স্বশাসন দুর্বল হবে এবং গ্রামসভাগুলি কার্যত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারাবে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সব মিলিয়ে সমালোচকদের বক্তব্য, "VB-G RAM G" বিল কাজের অধিকারকে ধীরে ধীরে খর্ব করে একটি শর্তসাপেক্ষ সরকারি প্রকল্পে পরিণত করছে বলে মত উঠেছে এসেছে দ্যা ওয়্যার-এর বিশেষ প্রতিবেদনে। কোনও বিস্তৃত আলোচনা বা শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই এই বিল আনার প্রক্রিয়াকে গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরাচার হিসেবেও দেখছেন অনেকে। তাঁদের মতে, এই পরিবর্তন কেবল একটি আইনের বদল নয়, বরং রাষ্ট্রের, তার নাগরিকদের প্রতি যে মৌলিক সাংবিধানিক দায়িত্ব- কাজ, মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত করার নীতির ওপর সরাসরি আঘাত।
