আজকাল ওয়েবডেস্ক: বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের জন্য ১৯৭১ সালের পর সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে, এমনই সতর্কবার্তা দিয়েছে সংসদের পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটি। কমিটির মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইসলামপন্থী শক্তির পুনরুত্থান, ক্ষমতার কাঠামোয় পরিবর্তন এবং চিন ও পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধির ফলে ভারতের নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির সামনে একটি গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে।

কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুরের নেতৃত্বাধীন এই কমিটির প্রতিবেদন সংসদে পেশ করা হয়েছে। এতে সরকারি আধিকারিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি বিশেষজ্ঞের সাক্ষ্য ও বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের মতো পরিস্থিতি এখন ভারতের অস্তিত্বগত সংকট নয়, তবে এর প্রভাব অনেক বেশি সূক্ষ্ম, দীর্ঘমেয়াদি এবং কাঠামোগত।

কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক রূপান্তর ও কৌশলগত রদবদল ভবিষ্যতে ভারতের নিরাপত্তা পরিবেশ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র  নীতিকে নতুনভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষ করে ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির ঐতিহ্যগত সম্পর্কের ভারসাম্যে পরিবর্তনের আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লিগের রাজনৈতিক দুর্বলতাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কমিটির মতে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়া এবং জনসমর্থনের ক্ষয় রাজনৈতিক পরিসরে নতুন শক্তির উত্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লিগ ৩০০টির মধ্যে ২২৪টি আসন পেলেও ভোটার উপস্থিতি ছিল আনুমানিক মাত্র ৪০ শতাংশ। এই কম উপস্থিতি নির্বাচনের বৈধতা ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিটি আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশে যুবনির্ভর জাতীয়তাবাদী আবেগ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রবণতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। এর পাশাপাশি ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলির পুনরুত্থানকে একটি সম্ভাব্য বিপদ সৃষ্টিকারী উপাদান হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই দুই প্রবণতার মিলন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগজনক বলেই কমিটির মত।

ভারতের দৃষ্টিতে আরেকটি বড় কৌশলগত উদ্বেগ হল বাংলাদেশে চিন ও পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই দুই দেশের প্রভাব বৃদ্ধির ফলে ঢাকার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের কৌশলগত ও রাজনৈতিক প্রভাব ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা সমীকরণকে জটিল করে তুলবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রক কমিটিকে জানিয়েছে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব থেকে ভারত–বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে যতটা সম্ভব সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। দিল্লি বর্তমানে ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছে এবং বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে বলে সরকার জানিয়েছে।

তবে কমিটি প্রশ্ন তুলেছে, আগাম সতর্ক সংকেত এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিবেদন থাকা সত্ত্বেও কেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে  পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হল। জবাবে সরকার জানিয়েছে, পরিস্থিতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং নিয়মিত মূল্যায়ন চালানো হচ্ছে।

প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিশা ও আন্তর্জাতিক অবস্থান ভারতের জন্য দীর্ঘদিন ধরে গভীর  নজরদারির বিষয় হয়ে থাকবে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ভূমিকা এবং ভারতের সামগ্রিক প্রতিবেশী নীতির প্রেক্ষিতে এই বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নয়াদিল্লির কৌশলগত চিন্তাভাবনায় বিশেষ গুরুত্ব পাবে।