আজকাল ওয়েবডেস্ক: সাত-এগারো মুম্বই লোকাল ট্রেন বিস্ফোরণ মামলায় প্রায় দুই দশক পরে এক যুগান্তকারী রায় দিল বম্বে হাইকোর্ট। ২০০৬ সালের ১১ জুলাই সাতটি ট্রেনে ধারাবাহিক বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন অন্তত ১৮৮ জন, আহত হন ৮০০-রও বেশি। এই ভয়াবহ ঘটনার জন্য ২০১৫ সালে মহারাষ্ট্র সংগঠিত অপরাধ দমন আইনের (MCOCA) অধীনে একটি বিশেষ আদালত ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে। এর মধ্যে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড, সাতজনকে যাবজ্জীবন এবং একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছিল। তবে গত ২১ জুলাই, ২০২৫-এ হাইকোর্ট জানায়, সরকার পক্ষ প্রমাণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা ১২ জন অভিযুক্তকেই খালাস দেয়— এমনকি ২০২১ সালে জেলে কোভিডে মারা যাওয়া এক আসামিকেও।

এই রায় দেশে বিস্ময়ের সঞ্চার করেছে। প্রশ্ন উঠেছে—জাতীয় নিরাপত্তা ও বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা কি ভেঙে পড়ছে? আদালত জানিয়েছে, সাক্ষীদের বয়ানে অসঙ্গতি, দেরিতে শনাক্তকরণ, স্বীকারোক্তির স্বেচ্ছাসীমা নিয়ে সন্দেহ এবং উপযুক্ত প্রমাণের অভাবের কারণে তারা এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। কিন্তু যে প্রমাণের ভিত্তিতে বিশেষ আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, সেটিকেই সম্পূর্ণভাবে খারিজ করে দেওয়া কি যথার্থ? নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রায় শুধু নিহতদের পরিবার নয়, বরং গোটা দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করেছে। একদিকে যেখানে সরকার বলছে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে “যেকোনো হামলা যুদ্ধের সমতুল্য”, অন্যদিকে এমন খালাস প্রমাণ করে দেয়—ভারত এখনো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে "সফট স্টেট" বলেই চিহ্নিত।

আরও পড়ুন:  সোমবার ভোরে উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে মন্দির চত্বরে দুইটি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ও হুড়োহুড়ির ঘটনায় মৃত্যু ১০ জনের, আহত বহু

এই রায় সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থা ATS এবং অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থার মনোবল ভেঙে দিতে পারে। বহু বছরের তদন্ত, বিপদের মুখে সংগ্রহ করা প্রমাণ, গোপন নজরদারি—সবকিছু যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। অবিলম্বে সংস্কার প্রয়োজন দেশের অপরাধ বিচার ব্যবস্থায়। সন্ত্রাসবাদ এখন সাইবার প্রযুক্তি ব্যবহার করে, অথচ বিচারব্যবস্থা আজও সাক্ষী আর জবানবন্দির উপরই নির্ভরশীল। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২৪ জুলাই হাইকোর্টের খালাসের রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এখন শীর্ষ আদালতের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ—ন্যায়বিচার ও জাতীয় নিরাপত্তার ভারসাম্য বজায় রাখা। প্রশ্ন একটাই—যদি ৭/১১ এর মত এত বড় হামলার জন্য কেউ দোষী না হয়, তাহলে আমরা কীভাবে বলব, ন্যায়বিচার হয়েছে?

এখন সময় এসেছে আত্মসমালোচনার। শুধুমাত্র পুলিশ ও প্রসিকিউশন নয়, বিচার ব্যবস্থাও যেন আর পুরনো কাঠামোয় না চলে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় প্রযুক্তি, নিরাপত্তা ও আইনগত সচেতনতা—সব কিছুর মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে এক নতুন, আধুনিক বিচারব্যবস্থা গড়তে হবে। যাতে দেশবাসী বুঝতে পারেন, বিচার মানেই ন্যায়, বিচার মানেই সুরক্ষা।

এই রায় কেবল একটি মামলার নিষ্পত্তি নয়, বরং আমাদের বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা এবং দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভবিষ্যতের ওপর বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন। এখন সময় এসেছে, যখন ভারতের বিচারব্যবস্থাকে জাতীয় নিরাপত্তার বাস্তবতা বুঝে তার ধারা ও পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। অপরাধ ও সন্ত্রাস যত আধুনিক হচ্ছে, বিচার প্রক্রিয়াকেও ততটাই আধুনিক ও বাস্তবমুখী হতে হবে—নইলে বিচার তো হবে, কিন্তু ন্যায় থাকবে না।