মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে দেবীর আগমনবার্তা—এই প্রভাতী অনুষ্ঠানকে আমরা আজ একপ্রকার ধর্মীয় আচার হিসেবেই দেখি। কিন্তু ইতিহাসের অন্দরমহল খুলে দেখলে বোঝা যায়, 'মহিষাসুরমর্দিনী' কেবল পূজা-পার্বণের সূচনাগান ছিল না, ছিল পরাধীন বাংলার প্রতিবাদের অগ্নিশিখা, ছিল স্বদেশিকতার উচ্চারণ।

প্রথমে এর নাম অবশ্য মহিষাসুরমর্দিনী ছিল না। কিন্তু দেবী দুর্গা ও দেশমাতৃকার প্রতীকী মিলন ঘটিয়ে যখন বাংলার আকাশে ভেসে উঠেছিল এই জয়গান, তখন তা হয়ে উঠেছিল এক নতুন প্রতিরোধের ভাষা। হিন্দু–মুসলমান, বাঙালি–অবাঙালি, ব্রাহ্মণ–অব্রাহ্মণ— জাতপাত নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে মানবতার পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে গড়ে তুলেছিলেন ঐক্যের জয়স্তম্ভ।

কালক্রমে 'মহিষাসুরমর্দিনী' হয়ে ওঠে বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক চিরন্তন স্বাক্ষর। আর সেখানেই তৈরি হয় সংঘাত। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ সরকার যেমন এই অনুষ্ঠানকে দমন করতে চেয়েছিল, তেমনই স্বাধীনতার পর দিল্লীর ক্ষমতাবলয় থেকেও এসেছিল নানা চক্রান্ত। কারণ বাঙালির এই নিজস্ব সৃষ্টিকে অনেকেই দেখেছিলেন চোখের কাঁটা হিসেবে।

অবাঙালি শাসক ও আমলারা নানা সময়ে অকারণে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করতে, কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই বাঙালিরা একজোট হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে—নিজেদের মৌলিকতাকে বাঁচাতে, নিজেদের অস্মিতা অক্ষুণ্ণ রাখতে। অবশেষে জয় হয়েছে বাঙালিরই। এবার সেই গল্পই মহালয়ার প্রাক্কালে মঞ্চস্থ হল অশোকনগর প্রতিবিম্ব-র প্রযোজনায়। নাটকের নাম 'নমস্ত্যসৈ'।
পার্থসারথি রাহার নির্দেশনা ও সামগ্রিক পরিকল্পনায় মঞ্চে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রে দেখা যাবে অশোকনগরের তৃণমূল বিধায়ক তথা উঃ চব্বিশ পরগণার সভাধিপতি নারায়ণ গোস্বামীকে।
এদিন দক্ষিণ কলকাতার রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহে এই নাটক মঞ্চস্থের আগে আজকাল ডট ইন-এর মুখোমুখি হলেন এই দাপুটে তৃণমূল নেতা। বললেন, " বহুদিন ধরেই বিভিন্ন সময়ে 'নমস্তসৈ' মঞ্চস্থ হচ্ছে। উত্তরবঙ্গতেও আমরা শো করেছি, কিন্তু মহালয়ার প্রাক্কালে ফের একবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রে মঞ্চে আবির্ভূত হওয়া নিঃসন্দেহে আলাদা অনুভূতি।"
সামান্য থেমে তিনি আরও বলেন, "আমাদের এই নাটক কিন্তু পর্দা উন্মোচিত করে সেই ঘটনার যে কীভাবে এই মহিষাসুরমর্দিনীর সূত্রপাত। অর্থাৎ তার জন্মকাহিনী। এ গল্প পর্দায় খুব একটা দেখানো হয়নি। এবং একইসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, চণ্ডীপাঠের পাশাপাশি এই নাটকে রয়েছে সংস্কৃতে স্তোত্রপাঠ, যা এই নাটকে আছে। পিয়াল ভট্টাচার্য এই নাটক প্রচুর গবেষণা করে লিখেছেন।"
কথায় কথায় আরও জানা গেল, নারায়ণ গোস্বামীর বাড়িতে যেহেতু বংশানুক্রমে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে বহু বছর ধরেই, তাই ছোট থেকেই শুনে, আউড়ে চণ্ডীপাঠ তাঁর সঙ্গে মননের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। তবু সাবধানের মার নেই, তাই সারাদিন কাজের শেষে মহড়াতে একাগ্রচিত্তে চণ্ডীপাঠ করতেন তিনি। জানা গেল, মহালয়ার সন্ধ্যায় 'নমস্ত্যসৈ'-এর আরও একটি শো হবে বারাসাতের রবীন্দ্র ভবনে এবং এই বছরে আপাতত সেটাই শেষ। কারণ, তারপর থেকেই আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনের নানান প্রস্তুতি শুরু হয়ে যাবে জোরকদমে। সেই পর্ব চুকলে ফের মঞ্চে ফিরবেন তিনি, জানালেন নারায়ণ গোস্বামী।
অন্যদিকে, এই নাটক দেখতে এদিন হাজির হয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাতি সোমিত সোম। আজকাল ডট ইন-কে তিনি জানান, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জন্মবার্ষিকীতে তাঁদের বাড়িতে শ্রদ্ধাঞ্জাপন করতে এসেছিলেন অশোকনগরের বিধায়ক। সেখানেই এই নাটকের ভাবনা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলে। সোমিত সোমের কথায়, "আমি ও আমার পরিবার এই প্রথমবার এই শো দেখতে এসেছি। দেখার পর যদি মনে হয়, আরও কিছু যোগ করলে এই নাটকের মান বৃদ্ধি পাবে, তাহলে সেই বিষয়ে অবশ্যই কথা বলব নারায়ণবাবুর সঙ্গে।"
মহিষাসুরমর্দিনী আজও শুধু একটি রেডিও অনুষ্ঠান নয়—এ এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব, এক পরিচয়ের চিহ্ন, এক অমর কণ্ঠস্বর।
আর তাই, দেবী বন্দনার সঙ্গে অমর হয়ে রয়েছেন—
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র—যার কণ্ঠধ্বনি আজও ভোরের বাতাসে গেয়ে ওঠে অমর সুরে।
বানীকুমার—যার কলমে ভেসে আসে চিরকালীন চিত্রকল্প।
পঙ্কজকুমার মল্লিক—যার সুরে মিলেমিশে গেছে ভক্তি, আবেগ আর প্রতিবাদ।
“যা দেবী সর্বভূতেষু”—এই বন্দনা তাই কেবল দেবীরই জয়গান নয়, বাঙালিরও জয়গান। এক অমর সৃষ্টি, যা আজও প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে গেয়ে যায় অস্মিতার মহাকাব্য।
মুখ্যচরিত্রে নারায়ণ গোস্বামী ছাড়াও 'নমস্ত্যসৈ'-এ পঙ্কজ কুমার মল্লিকের চরিত্রে রয়েছেন শ্যামল সরকার, বাণীকুমারের ভূমিকায় পার্থ প্রতিম মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকায় রাজীব বর্ধন এবং নাটকের সূত্রধরের জুতোয় পা গলিয়েছেন প্রান্তিক চৌধুরী।
