বলিউডে বরাবরই বাড়তে থাকা তারকাদের ‘এন্টোরাজ খরচ’ অর্থাৎ তাঁর অনুগামী, সহায়ক বা ব্যক্তিগত সহযোগী গোষ্ঠী নিয়ে বিপুল খরচ নিয়ে প্রযোজকদের অশান্ত গুঞ্জন শোনা যায়। অভিনেতাদের ‘এন্টোরাজ খরচ’ বা দলে দলে স্টাফ নিয়ে ঘোরা নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। এই প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন একাধিক নামী প্রযোজক-পরিচালক। এবার  মুখ খুললেন অভিজ্ঞ অভিনেতা সৌরভ শুক্ল। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্মৃতিচারণা করলেন কিংবদন্তি অভিনেতা অমরীশ পুরীর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার। জানালেন, কীভাবে কোটি টাকার তারকা হয়েও অমরীশ পুরী ছিলেন বাকি তারকা অভিনেতাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক ব্যক্তিত্ব। নিজের গাড়ি নিজে চালাতেন, সঙ্গে থাকত শুধু একজন মেকআপম্যান, আর কেউ নয়!

 

তাঁর হাঁক পাড়লেই মানুষ ভয়ে কাঁটা হয়ে যেত। চেহারার রুক্ষতা পর্দায় যেন আরও বাড়িয়ে দিত হিংস্রতার ছাপ। জনপ্রিয় সেই ভিলেন অমরীশ পুরী ছিলেন অন্যরকমের এক ব্যক্তিত্ব। অমরীশ নাকি ঘড়ির কাঁটা ধরে শুটিং সেটে পৌঁছে যেতেন। এক মুহূর্তও দেরি করতেন না তিনি। অন্য কেউ দেরি করুন তা-ও পছন্দ করতেন না।

 

প্রয়াত অভিনেতার সম্পর্কে সৌরভ বলেন, “ওই সময় আমার কাছে শুধু এইটুকুই বড় ব্যাপার ছিল যে আমাকে এত বড় ছবিতে কাস্ট করা হয়েছে—নায়ক: দ্য রিয়েল হিরো। বিশাল ছবি, বিশাল স্টারকাস্ট—অনিল কাপুর, অমরীশ পুরী। তখন আমি দূর থেকে তারকাদের দেখতাম আর ভাবতাম তারকা মানে তো তাঁর সঙ্গে থাকবে বিশাল দলদল, তাঁর ব্যক্তিগত একাধিক সব স্টাফ!”

 

কিন্তু সেটে গিয়েই ধাক্কা খান সৌরভ। হাসতে হাসতে বলেন, “আমি জানতে পারি, অমরীশ পুরী সাহেব নাকি প্রতিটা ছবিতে লিড অভিনেতার থেকে মাত্র এক টাকা বেশি পারিশ্রমিক নিতেন! ভাবুন কী আত্মসম্মানবোধ! অথচ ওঁর কোনও আপ্ত সহায়ক ছিল না, ব্যক্তিগত গাড়িচালক ছিল না। তাহলে থাকত কে? শুধু একজন মেকআপম্যান। আমি অবাক হয়ে একবার ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ আপনি এত বড় অভিনেতা, আপনার এত নাম, এত বছর কাজ করছেন, ব্যক্তিগত কোনও দলবল নেই?’ উনি হেসে বলেছিলেন, ‘আমি কি পাগল নাকি? আয় করব আমি আর আর সে সব টাকা দিয়ে দেব স্টাফদের? তাই নিজের গাড়ি নিজে চালিয়ে এসেছি। এন্টোরাজ নিয়ে সময় আর টাকা- দুটোই নষ্ট।’”

 

সৌরভের কথায়, “আজকের দিনে যেখানে অভিনেতাদের সঙ্গে যায় আপ্ত সহায়ক, ফটোগ্রাফার, স্টাইলিস্ট, প্রচার সচিব, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার, সেখানে অমরীশ পুরী একাই ছিলেন এক প্রতিষ্ঠান। তাঁর সরলতা, পেশাদারিত্ব আর শৃঙ্খলা থেকে আজকের প্রজন্ম অনেক কিছু শিখতে পারে।”

 

 


জানিয়ে রাখা ভাল, এই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান অভিনেতা এক সময়ে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছিলেন! কিন্তু স্রেফ এক মুহূর্তের জন্য বদলে গিয়েছিল সেই মানসিকতা। ‘বরফি’ ছবির সেটেই ঘটে গিয়েছিল সেই কাণ্ড। আর সেই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন রণবীর কাপুর! সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গে ‘জলি এলএলবি’ ছবিখ্যাত এই অভিনেতা বলেন, “ ‘বরফি’র শুটিংয়ের সময়টা আমার জীবনের সবচেয়ে টলোমলো পর্ব ছিল। অনুরাগ বসু যখন ছবিটার প্রস্তাব দেন, আমি ততদিনে অন্তর থেকে সত্যিই ভীষণ ক্লান্ত। ভীষণ বিরক্ত। কারণ সবাই বলত, ‘তুমি তো দারুণ অভিনেতা’, কিন্তু কাজ আসত কোনও ছবিতে একদিনের অতিথি চরিত্রের! একদিনের শুটে কী-ই বা করা যায়? কতটুকু-ই বা নিজেকে দেখানো যায়?”

অভিনেতা আরও বলেন, “তখন আমি প্রায় বলে দিয়েছিলাম, আমি অভিনেতা নই, আমি লেখক! আমি আর অভিনয় করব না। অনুরাগকে বলেছিলাম, ‘আমাকে কেবল তখনই ডাকবে যদি কিছু ভাল চরিত্র থাকে, না হলে একদম ডাকো না।’ ভাগ্যিস, ও সেটা খারাপভাবে নেয়নি! বরং বলেছিল, ‘স্যার, যদি কিছু না থাকত, আমি ডাকতামই না।’তারপরেই এল ‘বরফি’, এককথায় এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।”

আর সেই অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রণবীর কাপুর। সৌরভের কথায়, “এককথায় ভীষণ আকর্ষণীয়, প্রাণবন্ত আর কী যে দারুণ সব স্বপ্নে ভরা কোটাবাবারটা বলত... ওর সঙ্গে বসে আড্ডা মারাটা বড় আনন্দের ছিল। আর রণবীর শুধু শিক্ষিত নয়, বুদ্ধিমানও। যেকোনও বিষয়ে ওর সঙ্গে আলোচনা করা যায়। তাছাড়া, তরুণদের মধ্যে একটা নির্মল নির্ভেজাল ব্যাপার থাকে, একটা সারল্য থাকে যা আমাদের মতো বয়স বেড়ে যাওয়া মানুষের আর থাকে না।”

তিনি আরও যোগ করেন, “রণবীর ও আমার মধ্যে পরস্পরের জন্য শ্রদ্ধা ছিল। ও এমন কিছু করত অভিনয়ের সময় যে সেখান থেকে আমি কিছু করতাম পাল্টা, মানে আমি তার থেকে কিছু শিখতাম। সেই জায়গা থেকেই আমার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ফের জেগে ওঠে। মনে হল-হ্যাঁ, অভিনয় সত্যিই এক আনন্দের জিনিস! সেই থেকে আর পিছন ফিরে তাকাইনি।”