নিজস্ব সংবাদদাতা: সম্প্রতি দিন তিনেকের জন্য কলকাতা একপ্রকার চলে গিয়েছিল সুপারহিরোদের দখলে! আর কাদের মাধ্যমে এই কাণ্ডটি ঘটল? কলকাতা কমিক্স কার্নিভ্যাল। ধনধান্য অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হল এ বছরের কলকাতা কমিকস কার্নিভ্যাল। কার্নিভ্যালে যেমন ছিল সদ্য প্রকাশিত বিদেশি কমিকস, তেমনই স্টলের টেবিল আলো করে থাকে ফেলে আসা দিনের ইন্দ্রজাল কমিকস, ডিসি, মার্ভেল বা অমর চিত্র কথাও। ইতিউতি উঁকি মেরেছে চাচা চৌধুরী, বাঁটুল দি গ্রেট, বাহাদুর বেড়াল, রাপ্পা রায়। দেখা গেল টিনটিন, অ্যাস্টেরিক্স, অরণ্যদেবকেও। রয়েছে কমিক বুক নায়কদের আকর্ষণীয় সব অ্যাকশন ফিগার, পোস্টার, টিশার্ট, ব্যাজ, কি-রিং। বিপুল সম্ভার ছিল কার্টুন, অ্যানিমেশন ছবিতে সামুরাইয়ের কার্টুন-চরিত্রদের তলোয়ার থেকে জনপ্রিয় সব বাংলা-ইংরেজি মুভি পোস্টার-ও। বাদ যায়নি ‘কসপ্লে’-ও! কমিকসের চরিত্র সেজে বিভিন্ন রকমের ‘পারফরম্যান্স’। এই কমিক্স কার্নিভ্যালকে ঘিরে ছোট থেকে বড়- সবার উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। কারও চোখে ঝিলিক মারছিল অপার বিস্ময়, কারও বা মন লম্বা শ্বাস টেনে ডুব দিয়েছিল অতল নস্ট্যালজিয়ায়। যা দেখে কোন গম্ভীরমুখো জ্যাঠামশায়ের এবার সাধ্য আছে বলার যে কমিক্স, কার্টুন স্রেফ শিশুদের ব্যাপার-স্যাপার?
কমিক্স-অনুরাগীদের পাশাপাশি কলকাতা কমিকস কার্নিভ্যাল নিয়ে কী বলছেন বাংলার জনপ্রিয় কার্টুনিস্টরা? গত কয়েক দশক ধরে কার্টুন ও কমিক্স চর্চায় ব্রত থেকেছেন দেবাশীষ দেব, উদয় দেব এবং সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি সংবাদপত্র, বইয়ে নিয়মিত কার্টুন অলঙ্করণ করে গিয়েছেন এঁরা। বাংলায় এইমুহূর্তে অন্যতম প্রধান এই তিন কার্টুনিস্ট তথা অলঙ্করণ শিল্পীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল আজকাল ডট ইন।
দেবাশীষ দেব বললেন, “কমিকসের জন্য কিছু হলে তো ভাল-ই। আয়োজকদের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা। যদি এই কার্নিভ্যালের জন্য কমিক্স-পড়ুয়াদের সংখ্যাটা খানিক বাড়ে, তাহলে মন্দ কি! তবে সত্যি কথা বলতে কি, বাংলা কমিকসের পাঠক বাড়াতে প্রধান যে বিষয়টি নজর দেওয়া উচিত তা হল কমিকস-এর মান। একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কমিকস-এর মান কিন্তু পড়েছে। এমন নয় যে ভাল কাজ হচ্ছে না, তবে তা সংখ্যায় কম। সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় এঁরা সত্যিই খুব ভাল কাজ করে চলেছেন। আমি নিয়মিত এঁদের কাজ দেখি। কিন্তু বাংলা কমিকস-বাজারের মোটের উপর ছবিটা খুব ভাল নয়। আরও একটা কথা, কমিকস শিল্পীদের ঠিকঠাক, উপযুক্ত পারিশ্রমিক-ও তো দিতে হবে, নইলে তাঁরা ভাল কাজ করার উৎসাহ পাবেনই বা কী করে? এসব খুব নূন্যতম হলেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এদিকে যদি যত্নবান হওয়া যায়, তবেই না কমিকস-বাজার আরও বৃদ্ধি পাবে, মানের দিক থেকেও গুণগত হবে। এবং তারই সঙ্গে উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে পাঠককে, কমিকস পড়া ও পড়ানোর জন্য।”
উদয় দেব তাঁর নিজস্ব ছন্দে বলে উঠলেন, “কমিকস নিয়ে কিন্তু আমার তেমন পড়াশোনা নেই। এটা বিনয় নয়। কমিকস এবং কার্টুন দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। আমার কর্মক্ষেত্র সেখানে রাজনৈতিক কার্টুন। তার মানে এই নয় যে পলিটিক্যাল কোনও কমিক স্ট্রিপ্স হয়নি। প্রচুর হয়েছে। আমার নিজেরও তো কমিকস বেশ পছন্দের। কলকাতা কমিকস কার্নিভ্যাল প্রচুর সাড়া ফেলেছে শহরে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমার কানেও এসেছে সেসব। যাওয়ার খুব ইচ্ছে থাকলেও বিভিন্ন কারণে সেখানে গিয়ে উঠতে পারিনি। খুব সাধুবাদ জানাই আয়োজকদের। প্রচুর সমমনস্ক মানুষেরা একই জায়গায় আসছেন, আনন্দ করছেন কমিকস নিয়ে, কার্টুন চরিত্র সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন - এগুলো সত্যিই খুব আনন্দের। এরকম কমিকস উৎসব আরও হোক যাতে ছোটরা আসতে পারে সেখানে, কমিকসের প্রতি তাদের আগ্রহ, ভালবাসা বাড়ে। আমার শুধু একটি ব্যাপারে বলার রয়েছে, বিদেশী কমিকসের সঙ্গে যদি বাংলা কমিকসের জনপ্রিয় চরিত্রগুলিকেও যদি সমানভাবে এই কার্নিভ্যালে আনা যেত, তাহলে মনে হয় আরও ভাল হত। আরও একটু বিশদে বলি। ম্যানড্রেক, অরণ্যদেব বাঙালির হয়ে গিয়েছে বহু বছর আগেই। টিনটিন, স্নোয়িরা আমাদের নিজেদের হয়ে গিয়েছে সেই কবেই! আমরা বাঙালিরা তো সবাইকেই কাছে টানি, সেই কাছে টানার প্রসঙ্গ টেনেই প্রশ্ন রাখছি, এই উৎসবে কেন কেউ বাঁটুল সেজে, ভজা-গজা সেজে অথবা নন্টে-ফন্টে সেজে ঘুরে বেড়ায় না? যদি তা হত আরও একটু বেশি খুশি হতাম।”
 
 নিজের মতামত জানিয়েছেন জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র রাপ্পা রায়ের স্রষ্টা সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়-ও। তাঁর কথায়, “কলকাতায় কমিকস কার্নিভ্যাল হয়েছে, হচ্ছে তা অত্যন্ত আনন্দের আমার কাছে। কারণ কমিকস নিয়ে যত হইচই হবে, তত কমিকস ও কার্টুনের প্রকাশক ও পাঠক দুই-ই বাড়বে। আজকাল বাংলা কার্টুন-কমিকস বাজারে কিন্তু ভাল কাজ হচ্ছে, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। নয়া প্রজন্মের কার্টুনিস্টদের মধ্যে সায়ন পাল, সুমন্ত গুহ দুর্দান্ত কাজ করছেন। বাংলায় এত বছরে যে কমিকস বাজার তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তা কিন্তু হয়নি। তাই সাধুবাদ জানাই কলকাতায় কমিকস কার্নিভ্যালের আয়োজকদের। আমার বিশ্বাস, এর ফলে কমিকসের প্রতি আগ্রহ ও উৎসাহ দুই'ই বাড়বে মানুষের। তবে উদ্যোক্তা ও কমিকস-পাঠকদের উদ্দেশ্যে সার্বিকভাবে আমার একটি অনুরোধ রয়েছে। বিদেশি কমিকস, মাঙ্গা সব নিয়ে হইচই হোক, কিন্তু তার পাশাপাশি আমাদের নিজেদের, ঘরের যে কমিকস চরিত্র, তাদের নিয়েও হইচই হোক আরও বেশি করে। সেগুলো মানুষের কাছে আরও বেশি করে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হোক। এটুকুই।” 
প্রসঙ্গত, এই কলকাতা কমিকস কার্নিভ্যাল শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে। ২০২০-তে আইসিসিআর-এ আয়োজিত হয়েছিল কলকাতা কমিকস কার্নিভালের প্রথম উৎসব। আর প্রথম বছর থেকেই সাড়া মিলেছিল ভাল-ই। হবে নাই-ই বা কেন? শহরের অলিতে গলিতে কমিকস-পাগলদের সংখ্যা তো কম নয়। ধীরে ধীরে সেই উৎসব পরিণত হয় কার্নিভ্যালে। ২০২৫ সালের ধনধান্য অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হল কলকাতা কমিকস কার্নিভ্যাল।
