বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় মডেল-অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ। নাটক, টেলিফিল্ম-বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সিনেমায় অভিনয় করেও নজর কেড়েছেন তিনি। পদ্মা পেরিয়ে এবার টলিপাড়ায় পা রাখলেন তিনি। অনীক দত্তের নতুন ছবি ‘যত কাণ্ড কলকাতাতেই’ অন্যতম মুখ্যচরিত্রে দেখা যাবে তাঁকে। নওশাবার বিপরীতে রয়েছেন আবীর চট্টোপাধ্যায়। ছবিতে আবীর এবং নওশাবা দুজনেই ফেলুদাভক্ত, যদিও এই ছবি গোয়েন্দা গল্প নয়। বরং অ্যাডভেঞ্চার, ট্র্যাভেলগ এবং ফেলুদা-প্রেম মিলিয়ে এক অনাস্বাদিত ককটেল। এবার আজকাল ডট ইন-এর সঙ্গে মুখোমুখি নওশাবা। সাক্ষাৎকার না বলে একান্ত আলাপচারিতা বলাই ভাল। আড্ডায় যেমন উঠে এল অনীক দত্ত, আবীর চট্টোপাধ্যায় তেমনই ব্যাড গেল না বাংলাদেশ, দুর্গাপুজো, ওটিটি, ফেলুদা এবং অবশ্যই কলকাতা। শুনলেন রাহুল মজুমদার।
এই প্রথমবার টলিপাড়ায় কাজ করছেন। ‘যত কাণ্ড কলকাতাতেই’-এ কী এমন ছিল যা আপনাকে টানল?
নওশাবা: আমার সঙ্গে প্রথমে যোগাযোগ করেছিলেন অনীকদা। মানে, পরিচালক অনীক দত্ত। আর উনি কিন্তু আমার কোনও কাজ সেভাবে আগে দেখেননি। সমাজমাধ্যমে, বাবাকে কিছু খোলা চিঠি লিখতাম, সেসব লেখা পড়ে ওঁর খুব ভাল লেগেছিল। সেখান থেকেই যোগাযোগ। আমার এই বিষয়টা ভীষণই ভাল লেগেছিল যে, আমার পেশা অথবা গ্ল্যামারের সুবাদে নয়, উনি আমার জীবনের প্রতি, দেশের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

আপনার নিজের সঙ্গে এই চরিত্রটার মিল কতটা, কোন কোন জায়গায়?
নওশাবা: ‘যত কাণ্ড কলকাতাতেই’ ছবিতে আমার চরিত্রটির নাম ‘সাবা’ (হাসি)। আমার নামের সঙ্গে মিল তো আছেই। এর পাশাপাশি আরও কিছু জায়গায় বড্ড মিল। সাবাও আমার মতো পরিবারকে ভালবাসে, নিজের শেকড়কে কখনও অগ্রাহ্য করে না, মিউজিক, ঘোরাঘুরির পাশাপাশি পুরোনো আর্কিটেকচার তাঁর বড্ড প্রিয়। এককথায় সাবা প্রচণ্ড প্রাণবন্ত! জীবনকে বড্ড ভালবাসে। কিছুতেই হাল ছেড়ে দে না। আক্ষরিক অর্থেই শি ইজ ফুল অফ লাইফ!

অভিনেত্রী হিসেবে টলিপাড়ায় অনীক দত্তর মতো এক বিশেষ পরিচালককে প্রথম কাজেই পাওয়া— কেমন অভিজ্ঞতা?
নওশাবা: আজও মনখারাপ হলে যে কোনও সময়ে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ চালিয়ে দেখতে থাকি। ‘অপরাজিত’-ও আমার খুব প্রিয় ছবি। তবে ওঁর সব ছবি সেভাবে দেখা হয়নি। ‘অপরাজিত’ কিন্তু আমি আপনাদের কলকাতায় বসে দেখেছি। প্রথমবার দেখে সাধ মেটেনি। তাই পরের শো-টাও দেখে ফেলেছিলাম!(হাসি) তারপর দেখেটেখে অনীকদাকে একটা টেক্সট করেছিলাম। ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম এই বলে যে আমাদের প্রজন্মের কাছে সত্যজিৎ রায়কে এভাবে চেনানোর জন্য। আর বড় মাপের পরিচালক হওয়ার পাশাপাশি একজন সৎ মানুষ অনীকদা। তাই অভিনেত্রী হিসেবে তো বটেই, ব্যক্তি হিসেবেও ওঁর সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত!

আবীর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্ক্রিনশেয়ার করা, প্রথম পরিচয়, প্রথমবার অভিনয়— সবকিছু কেমন ছিল?
নওশাবা: আবীরদাকে নিয়ে কী যে বলি(অল্প হাসি)...ভীষণ ভাল একজন মানুষ। আবীরদা কিন্তু আমাদের এখানেও বিরাট বড় তারকা। অল্পবয়সী মেয়েদের কথা ছেড়েই দিচ্ছি, আমার মায়ের প্রজন্মের মহিলাদের মধ্যেও দারুণ জনপ্রিয় আবীরদা। আমি প্রথমে জানতাম না, আমার বিপরীতে কোন নায়ক রয়েছেন। তাই পরে যখন জানলাম আবীরদার কথা জানতে পেরেছিলাম, খুব খুশি হয়েছিলাম। ওঁর বিষয়ে আর একটা কথা বলা দরকার। আমি মানুষ হিসেবে একটু ইন্ট্রোভার্ট। চট করে প্রথম আলাপেই খোলামেলা হতে পারি না। আবীরদা প্রথম দিনেই সেটা বুঝেছিলেন। এবং বুঝে ভীষণ সাহায্য করেছিলেন। আবীরদা তো বটেই, ওঁর সহযোগীরাও আমাকে চিয়ার-আপ করেছিলেন। ওঁদের তো আমি রাখিও পরিয়েছিলাম, ওঁরাও আমাকে উপহার দিয়েছিলেন... উফ! কী সব মুহূর্ত যে কাটিয়েছি।

 
 বাংলাদেশের দর্শক আপনাকে যেমন চেনেন, এবার কলকাতার দর্শকও আলাদাভাবে দেখবেন— এই পরিবর্তনের জন্য মানসিকভাবে কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
নওশাবা: আমার বিশ্বাস, যদি নিজের কাজটা মন দিয়ে, সৎভাবে করি তাহলে দর্শক আমাকে গ্রহণ করবেন। পৃথিবীর যেকোনও জায়গায় দর্শকের ক্ষেত্রে এই কথাটা খাটে। আমাদের বাংলাদেশের দর্শকের স্বাদ একরকম, আপনাদের বাংলার দর্শকের ছবির স্বাদ আবার অন্যরকম। তাই চেষ্টা করেছি, ছবির ক্যাপ্টেন অর্থাৎ পরিচালক কী চাইছেন সেটা বুঝে, সেরকমভাবেই কাজ করতে। খুব চেষ্টা করেছি।
 
 আচ্ছা, ছবিতে তো তোপসের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। ফেলুদার উপন্যাস পড়া আছে? যদি থাকে, প্রিয় উপন্যাসগুলো কী কী?
 
  
 
 নওশাবা: কী বলছেন! অবশ্যই পড়েছি ফেলুদা (জোর গলায়)। ‘সোনার কেল্লা’, ‘রয়েল বেঙ্গলে রহস্য’, ‘বাদশাহী আংটি’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ -ফেলুদার এই গল্পগুলো আমার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু সবথেকে বেশি প্রিয় ‘সোনার কেল্লা’। আমার বাবারও খুব প্রিয় ছিল ফেলুদার গল্প-উপন্যাস।  

 
 আপনি কি মনে করেন, এই ছবিটি আপনার কেরিয়ারের জন্য এক নতুন অধ্যায় খুলে দিচ্ছে?
নওশাবা: একজন শিল্পীর চলার পথে নানান মাপের ও আকৃতির দরজা আসে। প্রতিটি দরজা আলাদা। তবে সত্যি কথা বলতে কী, এই দরজাটা আমার ভীষণ প্রিয়। একটা কথা বলি, ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে যখন প্রথমবার কলকাতায় এসেছিলাম, অদ্ভুত লেগেছিল। মনে হয়েছিল, এ কী রে, এ তো ঢাকা থেকে ঢাকাতেই চলে এলাম। সুতরাং, দুই দেশের সংস্কৃতির মেলবন্ধন হচ্ছে এরকম একটি শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারার অনুভূতি ভীষণ স্পেশ্যাল।

 
 বাংলাদেশের ও কলকাতার দর্শকের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য কোথায়?
নওশাবা: না, ঠিক পার্থক্য নয়। মনে, কী বলব এভাবে কখনও তুলনা করিনি (খানিক চুপ)।আমি কখনও গন্ধরাজ ফুলের সঙ্গে বেল ফুলের তুলনা করিনি। দু’টো ফুল একে অপরের থেকে আলাদা, কিন্তু দু’টোই আমার খুব প্রিয়। তাই আমি যদি কখনও স্পেনের ছবিতেও কাজ করি, সেখানকার দর্শককে গ্রহণ করব। এই যে বিভিন্ন জায়গার দর্শক একে অন্যের থেকে বর্ণময়, শিল্পী হিসেবে এটাই তো আমাদের ইন্সপায়ার করে! দুই বাংলার দর্শকের কাছেই তাই আমি কৃতজ্ঞ এবং শ্রদ্ধাশীল।

 
 দুই বাংলার মধ্যে যৌথ প্রযোজনা বা একসঙ্গে কাজ করার যে প্রচেষ্টা, সেটা অভিনেত্রী হিসেবে আপনাকে কতটা আশাবাদী করে তোলে?
নওশাবা: আমি মূলত মঞ্চাভিনেতা। তাই বিশ্বাস করি, যেকোনও কাজের ক্ষেত্রে সবাই মিলে সেটা করলে সফল হওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। তাই, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে কাজ করাটা একজন অভিনেত্রী হিসেবে আমাকে আশাবাদী করে তো তোলেই।

কলকাতার শিল্পীরা বাংলাদেশের কনটেন্ট নিয়ে আগ্রহী, আবার বাংলাদেশের দর্শকও টলিউড সিনেমা ভালবাসেন— আপনি কীভাবে দেখেন এই সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনকে?
নওশাবা: সেতুবন্ধন তো ভীষণ জরুরি! সেতু মানুষের মধ্যে যোগাযোগ, ভালবাসা বাড়ায়। সমৃদ্ধি করে সংস্কৃতিকে। তাই দুই বাংলাকে আরও কাছাকাছি আনতে এই সেতুবন্ধনগুলো আরও জোরালো করতে হবে।
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের পরিচালকরা যে সাহসী গল্প বলছেন, সেগুলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। টলিউড থেকে কী শিখে তাদের আরও এগোনো সম্ভব বলে মনে করেন?
নওশাবা: ৭১-এর পর নানারকম চড়াই উৎরাই-এর মধ্যে দিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। এইমুহূর্তে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম, তরুণেরা মানসিকভাবে খুবই শক্তিশালী, স্বাধীন। তাঁদের পড়াশোনা, বোধ....বিশেষ করে সিনেমা তৈরির জন্য যে পাগলামোর বাতাসটা প্রয়োজন তা কিন্তু এখানে বওয়া শুরু হয়েছে। তবে পশ্চিমবাংলা যেভাবে তারুণ্যের উদ্দামতাকে সাধুবাদ জানায়, সেরকম এখানেও হওয়া উচিত!
দুই বাংলার দর্শকের রুচিতে কতটা মিল খুঁজে পেয়েছেন আপনার চোখে?
নওশাবা: রুচিতে তো মিল থাকবেই। একই তো মাটি, বাতাসও একই। শুধু রান্না করার কায়দাটা তো একটু আলাদা। দু’পারের মানুষরা তো নদীর পাড়ের মানুষ। তাই কতই বা পার্থক্য থাকবে (হাসি) দুর্গাপুজো, ঈদে আপনারা যেমন মজা করেন, আমরাও করি। যখন দেখি, আপনাদের কোনও বাঙালি কন্যা আন্তর্জাতিক মঞ্চে সাফল্য পাচ্ছে, বাঙালি হিসেবে একইরকম আনন্দ আমাদের পদ্মাপারের মানুষদেরও হয়!
 
 বাংলাদেশি চলচ্চিত্র এখনও কড়া সেন্সর, বাণিজ্যিক চাপ, সীমিত হল সংখ্যার মতো চ্যালেঞ্জে ভুগছে— একজন অভিনেত্রী হিসেবে এসবের ভেতর কাজ করেন। অভিজ্ঞতা কেমন?
নওশাবা: প্রথম কথা বলব, সীমিত হল সংখ্যাটা সবথেকে বড় সমস্যার। বাণিজ্যিক চাপটাও নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর বাকি রইল কড়া সেন্সর... সেন্সরবোর্ড নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। নতুন বিধিমালা তৈরি হয়নি কারণ আমাদের এইমুহূর্তে যেহেতু সংসদ নেই। আর আমাদের দেশের মানুষ তো চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়েই সবসময় গিয়েছে...তবে একটা কথা আপনাকে বলতে পারি, আমাদের প্রকাশ করার ক্ষমতাকে কেউ আটকে রাখতে পারেনি, পারবেও না কোনওদিন। যে দেশে লালনের জন্ম, বাউলের আনাগোনা, যে দেশে জসীমউদ্দীন জন্মেছেন, সেখানে কোনওদিন সম্ভবই নয় সংস্কৃতিকে চেপে ধরে রাখার।
ওটিটির উত্থান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে কী ধরনের নতুন দরজা খুলে দিয়েছে বলে মনে করেন?
নওশাবা: ওটিটি একটা দারুণ ব্যাপার! বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের শিল্পীদের জন্যেও নিশ্চয়ই এই মাধ্যমটি। আমাদের দেশের প্রচুর প্রতিভাবান শিল্পীরা ওটিটিতে নিজের প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন, যা আগে সম্ভব ছিল না। কত গল্প বলতে পারছি আমরা, কত শিল্পী স্বাধীনভাবে, নতুনভাবে নানান রকমের কাজ হচ্ছে। এখানে শুধু শিল্পী নয়, শিল্পের জয়গান হচ্ছে।
বাংলাদেশের শিল্পীরা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাগৃহে কাজ করছেন, উৎসবে যাচ্ছে ছবি— আপনার কি স্বপ্ন আছে আন্তর্জাতিক কোনও প্রজেক্টে বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরার?
নওশাবা: আমার তো মনে হয়, প্রতিটি শিল্পীই আন্তর্জাতিক। স্বপ্ন তো দেখিই আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাজ করার। প্রয়োজন হলে সেখানকার ভাষা শিখে, সেখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম যে কাজ করব। ওই যে বললাম, এই স্বপ্ন তো একজন শিল্পী হিসেবে নিরন্তর দেখে চলেছি।
বাংলাদেশের নাটক ও চলচ্চিত্র দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক বক্তব্যের বাহক। আপনি কি মনে করেন, আজকের প্রজন্মের সিনেমাও সেই দায়িত্ব পালন করছে?
নওশাবা: অবশ্যই পালন করছে! নাটক তো সামাজিক বক্তব্যের বাহক। আমাদের মঞ্চে দারুণ দারুণ সব কাজ হচ্ছে। আমাদের দেশের ছোটছবিগুলোও আন্তর্জাতিক মঞ্চে সব যাচ্ছে, চোখে পড়ছে কত দেশের।
আর একটা প্রশ্ন, সুযোগ হলে এখানকার কোন কোন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে চান? কোন কোন অভিনেতা -অভিনেত্রীর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করার ইচ্ছে আছে?
নওশাবা: আমার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ চিত্রনাট্য। তারপরের ধাপে পরিচালক। এবং চিত্রনাট্য অনুযায়ী যে অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করতে হবে, আমি তাতেই রাজি। তবে হ্যাঁ, আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল ইরফান খানের সঙ্গে কাজ করার। আমার কঙ্কনা সেনশর্মার সঙ্গে কাজ করার ভারী ইচ্ছে। আর সত্যি কথা বলতে কী, স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই, তাই বলছি শাহরুখ খান, আমির খানের সঙ্গেও কিন্তু একদিন কাজ করার স্বপ্ন দেখি। ঠিক যেমন করে দেখি, ক্রিস্টোফার নোলান নিজে ডেকে আমাকে তাঁর ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দিচ্ছেন! (জোরে হাসি)।
