বলিউডের ইতিহাসে রেশমা পাঠান শুধু এক নাম নন, এক দুর্দমনীয় সাহসের প্রতীক। দারিদ্র্যব, পারিবারিক বাধা আর শরীরজুড়ে আঘাতের ক্ষত—সবকিছুকে পেরিয়ে তিনি হয়েছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা স্টান্ট শিল্পী। যিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সেই রাস্তায় বিপজ্জনক স্টান্ট করে সংসার চালাতে নেমেছিলেন। আর ১৯ বছর বয়সে পৌঁছে গিয়েছিলেন এমন এক সিনেমার সেটে, যা আজও ভারতীয় সিনেমার মুকুটে হিরে—‘শোলে’ (১৯৭৫)।

 

 

 

রেশমার খ্যাতির সূচনা হয়েছিল এখান থেকেই—যখন তিনি হেমা মালিনীর স্টান্ট ডাবল হয়ে পর্দায় ছুটে বেড়িয়েছিলেন ‘বসন্তী’র ঘোড়ার গাড়িতে। কিন্তু সেই খ্যাতির পেছনে লুকিয়ে আছে রক্ত, যন্ত্রণা আর অদম্য সাহসের ইতিহাস।

 

তবে এই ছবিতে স্টান্ট করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত রেশমা জানতেন না যে হেমা মালিনীর ডাবল হয়ে বলে ছবিতে হাজির হবেন। এই প্রসঙ্গে এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে রেশমা জানিয়েছেন—“আমাকে বলা হয়েছিল টাঙ্গা চালাতে হবে। আমি জুহু রোডে চালাতে চালাতে সোজা চলে গেলাম, ভুলেই গেছিলাম ফিরতে হবে। সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। তারপর সোজা নিয়ে যাওয়া হলো রমেশ সিপ্পির অফিসে। আমাকে মাপ নিল, পরচুলা পরাল। তখনও জানতাম না, আমি হেমা মালিনীর স্টান্ট ডাবল হতে চলেছি।”

 

মাত্র তিন দিন পর, বেঙ্গালুরুর কাছে রামনগরায় পৌঁছে তবেই বুঝতে পারলেন—এটা ‘শোলে’র সেট। আর সেখানেই প্রথম শুটিং—বসন্তীর সেই কিংবদন্তি চেজ সিকোয়েন্স, যেখানে গব্বরের লোকেদের হাত থেকে বাঁচতে টাঙ্গা নিয়ে দৌড়াতে হয়েছিল।

 

শুটিংয়ের সময় এক ভুলে ঘটে যায় বড়সড় বিপর্যয়। টাঙ্গার দুই চাকার মধ্যে একটিকে নকল দিয়ে বদলানো হয়েছিল, অন্যটি থেকে গিয়েছিল আসল। ফল—টাঙ্গা জোর ধাক্কা খায় এক পাথরে এবং এক বীভৎস ঝটকায় রেশমা উঁচুতে  ছিটকে পড়েন। টাঙ্গা এসে পড়ে তাঁর একেবারে গা ঘেঁষে। যদিও ক্যামেরায় ধরা পড়া সেই পড়ে যাওয়া দৃশ্যটা এতটাই বাস্তব লেগেছিল যে পরিচালক খুশি, কিন্তু রেশমা তখন রক্তাক্ত! পরে তাঁর বাঁ পায়ে ১৭ টিরও বেশি সেলাই পড়ে।

 

তবু হাসপাতালে ভর্তি হতে রাজি হননি। তাঁর কথায়—“আমার বোনের বিয়ের জন্য টাকা দরকার ছিল। ভয় ছিল, হাসপাতালে গেলে ছবি নির্মাতারা অন্য কাউকে দিয়ে আমার জায়গায় কাজ করাবে। তাই চেষ্টা করে দেখলাম যদি পারি, তবে শুট করব।” অদম্য জেদেই পরের শটও করেন তিনি। এমনকি যখন সেলাই খুলে গিয়ে রক্ত ঝরছিল, তখনও কাউকে কিছু জানাননি। তাঁর কথায়,  “জানালে তো আর শুট করতে দিত না। তাই চুপচাপ চালিয়ে গেছিলাম।”

 

‘শোলে’ থেকে শুরু হলেও রেশমা পাঠানের কেরিয়ার ছড়িয়ে পড়ে গোটা বলিউড জুড়ে। রাজেশ খান্না থেকে অমিতাভ বচ্চন—অসংখ্য তারকার জন্য তিনি করেছেন ঝুঁকিপূর্ণ স্টান্ট। তাঁর কেরিয়ারে ৪০০-রও বেশি ছবির নাম জড়িয়ে আছে। কিন্তু আসল সাফল্য শুধু তাঁর নিজের নয়—তাঁর লড়াই প্রমাণ করেছে, সিনেমায় স্টান্ট কেবল পুরুষদের হাতের খেলা নয়। তিনি দরজা খুলে দিয়েছেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ের—যেখানে নারী স্টান্ট আর্টিস্টরাও সমান মর্যাদা পেয়েছেন।

 

আজও শোলে-প্রেমীরা যখন “চল ধন্নো!” দৃশ্যটা দেখে হাততালি দেন, খুব কম মানুষই জানেন, সেই রক্ত-মাখা সাহসের আসল কারিগর ছিলেন রেশমা পাঠান। তিনি শুধু ‘শোলে গার্ল’ নন, তিনি এক সাহসিনী, যাঁর গল্প ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।