আজকাল ওয়েবডেস্ক: প্রায় তিন বছর ধরে রাশিয়ান তেলের ছাড়ে নির্ভর করে ইনপুট খরচ কমিয়ে জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রেখেছিল ভারতীয় রিফাইনাররা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। ফলে এখন দেশীয় রিফাইনারিগুলি একটি ব্যয়বহুল অপারেশন চক্রে প্রবেশ করছে। এই পরিবর্তন ইতিমধ্যেই পরিশোধন হার, আমদানি বিল ও ক্রয়নীতিতে প্রভাব ফেলছে।
ভারত তার প্রয়োজনীয় অপরিশোধিত তেলের প্রায় ৮৬% আমদানি করে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে রাশিয়া ভারতের সবচেয়ে বড় তেল সরবরাহকারী হয়ে ওঠে, যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আমদানির উৎস ছিল। সর্বোচ্চ পর্যায়ে ভারত প্রতিদিন প্রায় ১.৭৫ মিলিয়ন ব্যারেল রাশিয়ান তেল আমদানি করত—মূলত রোসনেফট ও লুকওইল থেকে।
তখন রাশিয়ান তেলের বড় সুবিধা ছিল প্রতি ব্যারেলে মধ্যপ্রাচ্যের দামের তুলনায় ৮–১২ ডলার ছাড় এবং নমনীয় অর্থপ্রদানের ব্যবস্থা যা বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে পরিচালিত হত। কিন্তু এখন সেই ছাড় কার্যত অর্ধেকে নেমে এসেছে।
সাম্প্রতিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সরাসরি সেই শিপিং, ইনস্যুরেন্স ও ট্রেডিং নেটওয়ার্কগুলিকে লক্ষ্য করেছে যেগুলির মাধ্যমে ভারতীয় রিফাইনাররা রাশিয়ান তেল আমদানি করত। ব্যাঙ্কগুলিও নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় আরও সতর্ক হয়েছে। ফলে লেনদেন ঝুঁকি বেড়েছে, ছাড় কমে এসেছে, এবং অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়ান তেলের ওপর ভারী নির্ভরতা এখন আর লাভজনক নয়।
আরও পড়ুন: ‘দুই যুবরাজ দুর্নীতির প্রতীক, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির দোকান খুলেছেন’, তীব্র কটাক্ষ
রোসনেফট ও লুকওইলের উপর নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বিশ্বের সরবরাহ ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। তেলের দাম এখন অস্থির পর্যায়ে রয়েছে। সমস্ত তথ্যও এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ভারতের তেল আমদানিতে রাশিয়ার অংশ ৩৬% থেকে কমে প্রায় ৩৪%-এ নেমে এসেছে। একই সঙ্গে প্রতি ব্যারেলে আমদানির খরচ এখন দুবাই-লিঙ্কড গড় দামের চেয়ে প্রায় ৫ ডলার বেশি। অক্টোবর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের তেল আমদানি বেড়ে প্রায় ৫.৭৫ লাখ ব্যারেল প্রতিদিন হয়েছে—২০২২ সালের পর সর্বোচ্চ—যা ইঙ্গিত করছে কৌশলগত পরিবর্তনের।
অপারেশনাল দিক থেকেও প্রভাব স্পষ্ট। সেপ্টেম্বরে অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াকরণের পরিমাণ গত ১৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে। সরকারিভাবে এটি রক্ষণাবেক্ষণজনিত কারণে বলা হলেও, রিফাইনারিগুলির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, সস্তা রাশিয়ান তেলের সুবিধা হারানোর ফলে পরিকল্পনা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ইতিমধ্যেই রোসনেফট-সংযুক্ত ক্রয় বন্ধ করে স্পট মার্কেট থেকে বৈচিত্র্যময় উৎসে ঝুঁকেছে। ইন্ডিয়ান অয়েল নতুন রাশিয়ান চুক্তি স্থগিত রেখেছে। ভারত পেট্রোলিয়াম ও ম্যাঙ্গালোর রিফাইনারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলির তেল কেনা বাড়িয়েছে। রাশিয়ান তেল কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে তেলের দাম আবারও বেড়েছে, যা সরবরাহ সংকট ও মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। এটি ভারতের আমদানি বিল ও আর্থিক ঘাটতিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
নীতিগতভাবেও পরিবর্তন ঘটছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কিং ও শিপিং ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার বজায় রাখা ভারতের জন্য অপরিহার্য, বিশেষ করে যখন দেশটি নিজেকে উৎপাদন ও সাপ্লাই চেইন হাব হিসেবে তুলে ধরছে। ফলে নয়াদিল্লির সাম্প্রতিক নীরবতা কোনো রাজনৈতিক ইঙ্গিত নয়, বরং একটি বাস্তব কৌশলগত পুনর্বিন্যাস।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—বর্ধিত খরচের ভার কে নেবে? আপাতত পাম্পে জ্বালানির দাম অপরিবর্তিত থাকলেও, রাষ্ট্রায়ত্ত তেল বিপণন সংস্থাগুলির ক্ষতি বহনক্ষমতা সীমিত। রাজনৈতিক ক্যালেন্ডার অনুকূলে এলে জ্বালানির খুচরা দামে সমন্বয় আসতে পারে, যদি না বিশ্ববাজারে তেলের দাম আবার কমে।
রাশিয়ান তেলের ছাড় ভারতের জন্য সবসময়ই ছিল একটি “অস্থায়ী সুযোগ”—স্থায়ী কৌশল নয়। এখন সেই সময় প্রায় শেষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতকে সরবরাহ উৎসের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে, দেশীয় উৎপাদনে সামান্য বৃদ্ধি আনতে হবে এবং কৌশলগত তেল মজুত ব্যবস্থাকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করতে হবে।
রিফাইনারিগুলি ইতিমধ্যেই তাদের ক্রয় ও প্রক্রিয়াকরণ কৌশল পরিবর্তন শুরু করেছে। পরবর্তী সমন্বয়—খুচরা জ্বালানি দামে বা সরকারি ভর্তুকিতে—অবশ্যই শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে।
