আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে লেখক ও প্রবীণ সাংবাদিক প্রেম শংকর ঝা তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ The Dismantling of India’s Democracy: 1947 to 2025–এ এক বিস্ফোরক বক্তব্য রেখেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে ‘Speaking Tiger’ প্রকাশনী। এতে ঝা বিশদে বর্ণনা করেছেন কীভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের বহুত্ববাদী, যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একটি একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসনের কাঠামো নির্মাণ করেছেন।

মোদির উত্থানের সূচনা এবং গুজরাট পর্ব

ঝা-র দাবি অনুযায়ী, মোদির ফ্যাসিবাদী যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার সময়, যখন তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর ভাষায়, "গুজরাট ছিল পরীক্ষাগার। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি সেই মডেলটি গোটা দেশে প্রয়োগ করেছেন।" গুজরাট দাঙ্গার ন্যায়বিচারের দাবিতে যাঁরা সোচ্চার ছিলেন—তাদের অনেকেই আজ কারাগারে আটক, অভিযোগপত্র ছাড়াই। যেমন: গৌতম নওলাখা, ভারাভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, স্ট্যান স্বামী (যিনি জেলে মারা যান)।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় মোদির প্রথম আঘাত

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই মোদি একটি ‘অদৃশ্য পর্দা’ নামিয়ে দেন সাংবাদিকতা ও সরকারী তথ্যপ্রবাহের উপর। ২০১৪ সালে শপথ নেওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি সমস্ত মন্ত্রকের দরজায় সিসিটিভি বসান এবং সাংবাদিকদের ‘PIB (Press Information Bureau)’ কার্ড প্রত্যাহার করে নেন। এই কার্ডটি ছিল সাংবাদিকদের জন্য একটি প্রবেশপত্র, যার মাধ্যমে তাঁরা মন্ত্রী বা আমলাদের সঙ্গে পরিচয় না দিয়েও নীতিগত বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন। নেহরু যুগে চালু হওয়া এই পদ্ধতি গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মোদির প্রথম কৃতকর্মই ছিল তা নিঃশেষ করে দেওয়া।

প্রশাসনের উপর বিজেপি হাইকম্যান্ডের নজরদারি

এরপর মোদি প্রশাসনিক ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে শুরু করেন। প্রতিটি মন্ত্রকের মাসিক বৈঠকে উপস্থিত থাকেন মন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট আমলা এবং একজন বিজেপি প্রতিনিধি। ফলে নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা মন্ত্রকের বদলে চলে যায় বিজেপির হাতে। আমলারা হয়ে পড়েন নিয়ন্ত্রিত, স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেন।

সংবাদমাধ্যমের ওপর দ্বিতীয় আঘাত

মোদির পরবর্তী লক্ষ্য ছিল স্বাধীন গণমাধ্যম। যারা সরকার সমালোচনামূলক প্রতিবেদন করত, তাদের বিরুদ্ধে হানা দেয় আয়কর বিভাগ, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ED), এবং CBI। এনডিটিভির প্রতিষ্ঠাতা প্রণয় ও রাধিকা রায় এই নিপীড়নের মুখ্য শিকার হন। অবশেষে ২০২২ সালে NDTV বিক্রি হয়ে যায় আদানি গোষ্ঠীর হাতে। এরপর NDTV তার স্বাধীন কণ্ঠ হারায় এবং বর্তমান শাসকদলের মুখপাত্রে পরিণত হয়।

বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ

ঝা-র মতে, মোদি সরকার ভারতের উচ্চতম আদালতকেও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। যেসব বিচারপতি সরকারের পক্ষে অবস্থান নেন, তাঁদের ‘পুরস্কার’ হিসেবে দেওয়া হয় রাজ্যপাল বা গুরুত্বপূর্ণ কমিশনের পদ। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি পি. সাথাসিবমকে কেরালার রাজ্যপাল করা হয়, বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-কে রাজ্যসভায় মনোনীত করা হয়, এবং বিচারপতি খানউইলকার-কে ‘লোকপাল’-এর পদে বসানো হয়।

আরও বিপজ্জনক তিন পদক্ষেপ

১. মোদির নীরবতা: ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকলেও মোদি কখনোই খোলামেলা সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। জনতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এড়িয়ে গেছেন।

২. জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের অকার্যকরতা: কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে নীতি সমন্বয়ের প্রধান প্ল্যাটফর্ম ছিল National Development Council (NDC)। মোদির শাসনে এটি কার্যত বিলুপ্ত।

আরও পড়ুন: এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট AI 171 ভয়াবহ দুর্ঘটনা: তদন্তে প্রকাশ, টেক-অফের পরপরই বন্ধ হয়ে যায় দুই ইঞ্জিন

৩. পরিকল্পনা কমিশনের বিলুপ্তি: ২০১৫ সালে পরিকল্পনা কমিশন ভেঙে গড়ে তোলা হয় ‘NITI Aayog’। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব—রাজ্য সরকারগুলিকে উন্নয়ন তহবিল বরাদ্দ করার কাজ—সরিয়ে নিয়ে মোদি নিজের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নেন। পূর্বে গাডগিল ফর্মুলা অনুসারে, প্রয়োজন অনুযায়ী এই তহবিল বরাদ্দ হত; এখন বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে, বাকি রাজ্যরা বঞ্চিত হচ্ছে।

প্রেম শংকর ঝা-র এই বইটি শুধু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক সতর্কবার্তা। ঝা বলেন, “এটি আর শুধু রাজনৈতিক কৌশল নয়—এটি ভারতের আত্মাকে ধ্বংস করার পরিকল্পিত প্রয়াস।” বইটির এই অধ্যায়ে স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে যে ভারতের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গভীর সংকটে।