আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারত-সফরে এসেছেন বিশ্ব ফুটবলের মহানায়ক লিওনেল মেসি। অথচ দেশে এখন ফুটবলই বন্ধ। বড় কঠিন এক সময়। কবে দেশে বল গড়াবে কেউ জানেন না। অনেকেই মনে করছেন, এবার ফুটবলের প্রতি আগ্রহ হারাবেন সবাই। অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের ফুটবল খেলতে আর পাঠাবেন না।
এমন এক সময়ে লিওনেল মেসি ভারতীয় ফুটবলকে যেন জীবন দিয়ে গেলেন। তাঁর স্নেহপরশে কি মৃতপ্রায় ফুটবল সঞ্জীবনী পেল? তার উত্তর দেবে সময়। তবে রবি-সন্ধ্যায় ওয়াংখেড়েতে যে ফ্রেম তৈরি হয়ে গেল, তা সারাজীবনের সঞ্চয়।
অস্ফুটে এলএম ১০ যেন বলে দিয়ে গেলেন, এই দেশ থেকে আরও সুনীল ছেত্রী তৈরি হতেই পারে। ভাবীকালকে উৎসাহ জুগিয়ে গেল লিও মেসির রবিবারের মুম্বই সফর। মেসির ভারত সফরে যেমন কলকাতা আছে, তেমনই হায়দরাবাদ রয়েছে, রয়েছে মুম্বইও।
সৃষ্টিসুখের আনন্দে মেতে ওঠেন মেসি। যুবভারতীতে মেসি-মুহূর্ত কিন্তু সুখকর নয়। সেখানে ধ্বংসের ছবি আঁকা হয়েছে। মুম্বই সেখানে অন্য মেরুতে। অসংখ্য স্বপ্নের বীজ বোনা হল বাণিজ্যনগরীতে।
ফিফার ক্রমতালিকায় ক্রমশ পিছোতে থাকা এক দেশের মহাতারকা ফুটবলারকে মেসি সম্মান দিয়ে গেলেন। তাঁর কৃতিত্বকেও স্বীকৃতি দিয়ে গেলেন।
মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়েতে অনেক স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। এই বিশালাকায় স্টেডিয়ামেই ২৮ বছর পরে ভারত ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তাও চোদ্দো বছর আগে।
বহু ঘটনার অভিঘাতে অনেক কিছু ভুলে গেলেও নুয়ান কুলশেখরাকে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলার মহেন্দ্র সিং ধোনি-মুহূর্ত ভোলার নয়। গ্যালারিতে সেদিন জয়ধ্বনি হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের।
শচীন তেণ্ডুলকরের অমৃতকুম্ভে এদিন সোনালী এক ফ্রেম তৈরি হল। লিও মেসি পরম শ্রদ্ধায়, ভালবাসায়, আদরে সুনীল ছেত্রীকে ছুঁলেন। ওই ছোঁয়া ভারতীয় ফুটবলকেও মুহূর্তে যেন নবজন্ম দিয়ে গেল। অনেক আশার প্রদীপও জ্বালিয়ে গেল ওয়াংখেড়েতে।
ফুটবলে সুনীল ছেত্রীর দেশ এখন অসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তিনিই তো ফুটবল মাঠে এই দেশের পতাকাবাহক।
তিনি একা বল নিয়ে ছুটেছেন। গোল করেছেন। একসময়ে গোল করায় রোনাল্ডো-মেসির ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলেছেন। রেকর্ড বইয়ের পাতায় মেসি নিশ্চয় সুনীল ছেত্রীর নাম দেখে থাকবেন। সেই রেকর্ড দেখে মেসির হয়তো মনে হয়েছিল, অখ্যাত-অজানা দেশের কে এই বিখ্যাত ফুটবলার যে আমাকেও দূর থেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে?
সেই মেসি ও সুনীল ছেত্রীর দেখা হল ওয়াংখেড়েতে। সুনীলের পিঠে স্নেহের পরশ মেসির। ইতিহাসের পাতার দুই সম্রাটের অমর সংলাপ মনে পড়তে বাধ্য।
যুদ্ধে পরাজিত পুরুকে আলেকজান্ডার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ''আপনি আমার কাছে কেমন ব্যবহার আশা করেন?''
বুক চিতিয়ে পুরু জবাবে বলেছিলেন, ''একজন রাজা অপর একজন রাজার কাছে যেমন ব্যবহার আশা করেন।''
সুনীল ও মেসি দুই তারকা। সুনীলের প্রতি মেসির শ্রদ্ধা-ভালবাসা পুরনো সেই সংলাপকেই যেন আরও একবার মনে করিয়ে দিয়ে গেল ওয়াংখেড়েতে। একজন আরেকজনকে দেখে যেন গান ধরেছেন, ''তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী...।''
মেসি ওয়াংখেড়েতে পা রাখার আগে সেভেন আ সাইড ফুটবল ম্যাচ চলছিল। সুনীল সেখানে হেডে দুর্দান্ত এক গোল করেন। তখনও মেসির আবির্ভাব হয়নি। খেলা চলাকালীনই থ্রি মাস্কেটিয়ার্স-মেসি, সুয়ারেজ ও দি পলের মাঠে প্রবেশ।
দু'দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন তিন মহাতারকা। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ফুটবলারদের তালিকায় সবার শেষে দাঁড়িয়ে সুনীল ছেত্রী। মেসি এগিয়ে গেলেন সুনীলের দিকে। আর্জেন্টাইনের হাসি ততক্ষণে লক্ষ ওয়াট ছাড়িয়েছে। সুনীলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন।
ভারতীয় কিংবদন্তির পিঠে হাত রাখলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। গ্যালারি ততক্ষণে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। গগনভেদি চিৎকারে কান পাতা দায়। এ তো দেশের ফুটবলের জন্য গর্বের এক মুহূর্ত।
কে বলে ভারতীয় ফুটবল পিছিয়ে গিয়েছে? কে বলে বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে ভারতীয় ফুটবল মুছে যেতে বসেছে? রবি ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার লাইন মনে করিয়ে দেন সুনীল ছেত্রী, ''দিনের পথিক মনে রেখো, আমি চলেছিলেম রাতে, সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে।''
সুনীলকে জড়িয়ে ধরছেন মেসি। সুনীলের হাতে হাসতে হাসতে মেসি তুলে দিচ্ছেন দশ নম্বর লেখা আর্জেন্টিনার জার্সি। এই ছবি ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।
এই ছবি বিজ্ঞাপন হোক দেশেবিদেশে। স্পনসররা টাকার থলি নিয়ে এগিয়ে আসুন, এরকম আরও অনেক সুনীল ছেত্রী তৈরি করার নেশায়। ফুটবলের মাদকতা ছড়িয়ে পড়ুক রক্তে।
ফুটবল বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশে এসে মেসি ফুটবল খেলেননি। কিন্তু তিনি আদরে-আলিঙ্গনে সুনীলের শ্রেষ্ঠত্বে সিলমোহর দিয়ে গেলেন। পক্ষান্তরে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে দোদুল্যমান দেশের ফুটবলেও যেন প্রাণের ছোঁয়া দিয়ে গেলেন।
ধুঁকতে থাকা, নুইয়ে পড়া জীবন বলে উঠুক জোর গলায়, সুনীল ছেত্রী পারলে আমরা পারব না কেন? মেসির ভারত সফর কেবল ধ্বংসের ছবি আঁকে না। নতুন ভোরেরও সন্ধান দেয়। ঘুম থেকে জেগে ওঠার বার্তা দিয়ে যায়।
সুনীল ছেত্রী কেবল দেশের নন, তিনি পৌঁছে গিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। যেখানে সবাই জানেন সুনীল ছেত্রী তাঁর দেশ ভারতের হয়ে গোল করেন। সুসময়ে ও দুঃসময়ে।
এ সব দৃশ্য দেখলে বলতে ইচ্ছা করে, আমাদেরও একজন সুনীল ছেত্রী রয়েছেন। যে সুনীল ছেত্রী কেরিয়ারের সায়াহ্নে পৌঁছেও দেশের হয়ে গোল করে যান মহাসম্রাটের সামনে। সুনীল ছেত্রী, আপনাকে সেলাম।
