সম্পূর্ণা চক্রবর্তী: রবিবাসরীয় রাত। ভারতীয় সময় এগারোটা ছুঁইছুঁই। এজবাস্টনে সবে মাত্র ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। তারই মধ্যে বেজে উঠল সৌরাশিস লাহিড়ীর ফোন। অন্য প্রান্তে ভিডিও কলে আকাশ দীপ। শুভমন গিল ম্যাচের সেরা হলেও, এজবাস্টন জয়ে সমান ভূমিকা রয়েছে বাংলার পেসারের। বার্মিংহ্যামে তুলে নেন দশ উইকেট। প্রথম ইনিংসে চার, দ্বিতীয় ইনিংসে ছয়। স্বাভাবিক ভাবেই উচ্ছ্বসিত। যার হাত ধরে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল, তাঁকে কি ভোলা যায়? যখন আকাশ প্রথমবার বাংলায় যোগ দেন, অনূর্ধ্ব-২৩ বাংলা দলের কোচ ছিলেন সৌরাশিস।‌ তাঁর অধীনেই প্রথম পেশাদার বোলিংয়ে ট্রেনিং। তাই প্রাক্তন কোচ এবং মেন্টরকে ভোলেননি আকাশ দীপও। রাতেই বার্মিংহ্যাম থেকে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হয় ভারতীয় দল। তার আগে সৌরাশিসকে ফোন করেন। চতুর্থ দিন বেন ডাকেট, অলি পোপ এবং জো রুটের স্ট্যাম্প ছিটকে দেওয়ার পরও বাংলার কোচকে ফোন করেছিলেন। নিয়েছিলেন টিপস। এই সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হলেও, পা রয়েছে মাটিতেই। সৌরাশিস বলেন, 'টেস্ট চলাকালীন আমার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই আকাশ দীপের কথা হয়েছে। চতুর্থ দিনের পরও আমাকে ফোন করেছিল। টেস্ট জেতার পরও ভিডিও কল করে। রাতেই ভারতীয় দল বার্মিংহ্যাম থেকে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। ১০ উইকেট পাওয়ায় অবশ্যই খুশি ছিল। কিন্তু কোনও অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস ছিল না। সবসময় ওর পা মাটিতে থাকে। ও সাফল্যে গা ভাসিয়ে দেওয়ার ছেলে নয়। জানে ওর কাজ ভারতকে জেতানো। দুই ইনিংসে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছে। এতেই খুশি।' 

বিহারের সাসারামের ২৮ বছরের পেসারের কলকাতায় প্রথম ক্লাব মোহনবাগান। ২০১৯ সালে সৌরাশিসের হাত ধরেই বাংলায় আসা। কিন্তু যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না। কোমরে গুরুতর চোট পান। যাতে ক্রিকেটজীবনে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারত। সেখান থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উত্থান। খুব অল্প দিনের মধ্যেই জুনিয়র দল থেকে সিনিয়র দলে সুযোগ। সেই দিনগুলোর কথা তুলে ধরেন বাংলার অনূর্ধ্ব-২৩ দলের প্রাক্তন কোচ। সৌরাশিস বলেন, 'প্রথম দিন থেকেই ওর মধ্যে একটা এক্স ফ্যাক্টর ছিল। তবে বাংলায় যখন প্রথমবার আসে, ওর কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। পুরো রুকি ছিল। টেনিস বল ক্রিকেট খেলত। লাল বলের ক্রিকেটে কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। শুধু জোরে বল করত। বোলিং নিয়ে কোনও ধারণাই ছিল না। কলকাতায় ইউনাইটেড ক্লাবে সই করেছিল। কিন্তু খেলছিল না। আমাকে জয়দীপ মুখার্জি ওর বিষয়ে বলে। তারপর ও ইন্ডোরে আসে। প্রথমবার দেখেই ওকে ভাল লেগেছিল। ওর কোমরে স্ট্রেস ফ্র্যাকচার হয়, যা খুবই ভয়ঙ্কর হতে পারত। সেই সময় সৌরভ গাঙ্গুলি, অভিষেক ডালমিয়া খুবই সাহায্য করেছে। কোচ হয়ে আমি সবসময় চাইতাম ওকে খেলাতে। তবে ওদের থেকে সেই সমর্থন না পেলে পারতাম না। সেই সময় ওর রিহ্যাব চলছিল। ম্যাচ খেলছিল না। ওকে নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। কিন্তু সিএবি ওর পাশে ছিল। এরপর যখন থেকে খেলা শুরু করেছে, আর ফিরে তাকায়নি। প্রথম দু'বছর অনবদ্য ছিল। দ্বিতীয় বছরই বাংলার সিনিয়র টি-২০ দলে সুযোগ পায়। তারপর দিন্দার জায়গায় রঞ্জি ট্রফিতে খেলে। প্রথম ম্যাচেই ছয় উইকেট নেয়। বাকি যাত্রাটা অনবদ্য।' 

বর্তমানে আইপিএলের পারফরম্যান্সের নিরিখে টেস্ট দলের নির্বাচন হয়। সম্প্রতি এর বেশ কয়েকটা উদাহরণ রয়েছে। যাতে সার্বিকভাবে লাভ হয়নি ভারতীয় ক্রিকেটের। বাংলার প্রাক্তন বোলারের দাবি, আকাশ দীপ ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের আদর্শ প্রোডাক্ট। কোনও সমর্থন, শর্টকাট ছাড়াই এই জায়গায় পৌঁছেছে তাঁর ছাত্র। এই প্রসঙ্গে সৌরাশিস বলেন, 'এর আগে সাতটা টেস্ট ম্যাচ খেলেছিল। ভারতের হয়ে টেস্ট খেলতে হলে ঘরোয়া লাল বলের ক্রিকেটে সফল হতে হবে। আকাশ দীপের নির্বাচন এটার আদর্শ উদাহরণ। বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে বল করা শিখতে হবে। ও এমন একজন যে ক্রমাগত পরিশ্রম এবং লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। কেউ ওকে আলাদা করে সাপোর্ট করেনি। আইপিএলের নাচন-কোদোনের মধ্যে সুযোগ পায়নি। ও ভারতের, তথা বাংলার শক্তিশালী ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রোডাক্ট। ও লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছে। সেটা ওর বোলিংয়ে প্রতিফলন হয়। ও শর্টকাটের মধ্যে দিয়ে উঠে আসেনি। সেই জন্যই সবচেয়ে কঠিন সময়ের মধ্যে নিজেকে মেলে ধরেছে।' 

এজবাস্টনে প্রথম ইনিংসে চার উইকেট তুলে নেওয়ার পরও লর্ডস টেস্টে সুযোগ পাওয়া নিয়ে সন্দিহান ছিলেন বাংলার পেসার। যশপ্রীত বুমরার জায়গায় খেলছেন। লর্ডসে ফিরবেন বিশ্বের একনম্বর পেসার। সাফল্য না পাওয়া সত্ত্বেও পরপর দুই টেস্টে সুযোগ পান প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ। ভারতীয় দল নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন আকাশ দীপের প্রাক্তন কোচ। প্রসঙ্গ তোলেন আরেক বাংলার পেসার মুকেশ কুমারের। গৌতম গম্ভীরকে নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। সৌরাশিস বলেন, 'হর্ষিত রানাকে যদি ভারতের কোচ ডাকে, তাহলে মুকেশকে বঞ্চিত হতে হবে। একটা সিরিজ না খেলেই ভারতীয় টেস্ট দলের অঙ্গ ছিল ও। দুর্ভাগ্যের। অবশ্য খুব দুর্ভাগ্যের বিষয় নয়, কারণ ভারতীয় কোচের প্রথম কোচিং অ্যাসাইনমেন্ট ভারতীয় দল। মুকেশ যেখানেই খেলেছে ভাল খেলেছে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে রেকর্ড নজরকাড়া। আইপিএল দেখে ভারতীয় টেস্ট দল বেছে নেওয়া উচিত নয়।' ওয়ার্কলোডের জন্য সব ম্যাচে খেলানো হচ্ছে না যশপ্রীত বুমরাকে। চোটের জন্য দীর্ঘদিন লাল বলের ক্রিকেটে নেই মহম্মদ সামি। ভবিষ্যতে টেস্টে বাংলা থেকে আকাশ দীপ এবং মুকেশ কুমারের জোড়া ফলাকে দেখার আশায় সৌরাশিস।‌