আজকাল ওয়েবডেস্ক: নবি মুম্বই থেকে ওয়াংখেড়ের দূরত্ব কত? সার্চ ইঞ্জিন বলছে ৩৬ কিমির মতো। 

১৪ বছরের ব্যবধানে দুই বিন্দুতে লেখা হল ইতিহাস। ২০১১ সালে ওয়াংখেড়েতে কাপ হাতে নিয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। সেই তিরাশিতে কপিলরা লর্ডসের বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন একমুঠো রোদ্দুর। ধোনির পেল্লাই ছক্কায় ২৮ বছরের অনন্ত প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়েছিল রাঁচির রাজপুত্রের টিম ইন্ডিয়া।

এই ২০২৫-এ নবি মুম্বইয়ে বেনজির এক ইতিহাস লিখে গেলেন হরমনপ্রীত কৌররা। আগের দু'বার ফাইনালে পৌঁছেও কাপ আনা হয়নি দেশে। কথায় বলে ত্র্যহস্পর্ষ ভাল নয়। তৃতীয় বারের চেষ্টায় ভারতের মেয়েরা জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন দখল করলেন। তিনের ছোঁয়া মানেই অপয়া, এই বস্তাপচা থিওরিও কি আরব সাগরে ছুড়ে ফেলা গেল? 

ভাইয়ের পরিবর্ত হিসেবে নেমে কেউ পুরস্কার জিতেছিলেন। আবার বোনের জন্য আত্মত্যাগের নজির রয়েছে দাদার। কেউ আবার শুরুতে বলই মাঠের বাইরে পাঠাতে পারতেন না। সেই সব ভারতলক্ষ্মীরা রবি-সন্ধ্যায় একসঙ্গে যেন গেয়ে উঠলেন নতুন দিনের গান। 

একসময়ে খেলতে যাওয়ার জন্য রিজার্ভ-হীন কামরায় সওয়ার হতে হয়েছিল মহিলা ক্রিকেটারদের। মেঝেতে শুয়ে কাটাতে হয়েছিল রাত। যে বীজ পঞ্চাশ বছর আগে বপন করা হয়েছিল, আজ তাই ফুল-ফল-ছায়া বিছিয়ে দিল। আজ থেকে মহিলা ক্রিকেটাররা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। 

আজকের পর থেকে কোনও নামী কর্তা নিশ্চয় বলবেন না, ক্ষমতা থাকলে মহিলাদের ক্রিকেটটাই বন্ধ করে দিতাম। 

এই দেশেই মহিলারা মহাকাশে পাড়ি দেন।  আবার বিশ্ব ক্রিকেটে ইতিহাসও সৃষ্টি করেন! হরমনপ্রীতরা আজ গোটা দেশের মহিলাদের অধিকার ছিনিয়ে নিলেন বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। 

নবি মুম্বইয়ের ফাইনালে ভারত ৫২ রানে হারাল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এই জয়ের রূপকার যে সবাই। এগারোজন হিংস্র বাঘিনী দৌরাত্ম্য দেখিয়ে গেলেন। আর সাজঘরে ছিলেন এক চাণক্য অমল মুজুমদার। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে এই ভারতের পরিক্রমা প্রসঙ্গে বলছেন, ''ম্যাজিকাল।'' 

প্রতিটি মুখের পিছনেই রয়েছে কিছু না কিছু গল্প। ভারতের মহিলা দলের প্রতিটি ক্রিকেটারের জীবনেই রয়েছে মন কেমনের অনেক গল্প। সেই গল্প প্রেরণা জোগায়। সেই গল্প চোখে জল আনে। 

ছেলেদের ক্রিকেটে নেমে ম্যাচের সেরা হয়েছিলেন শেফালি ভার্মা। সেই প্রতিযোগিতায় খেলার কথা ছিল তাঁর ভাইয়ের। কিন্ অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে ভাইয়ের আর নামা হয়নি। অসুস্থ ভাইয়ের জার্সি পরে খেলতে নেমে পড়েন শেফালি। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। মেয়ে বলে কেউ সেদিন বুঝতেই পারেনি শেফালিকে। ছোট্ট শেফালি চুটিয়ে ব্যাট করে ম্যাচের সেরা হয়েছিলেন। এহেন শেফালির ব্যাট আজ নবি মুম্বইয়ে ঝড় তুলল। ৭৮ বলে ৮৭ রান করলেন তিনি। সাতটি চার ও ২টি ওভার বাউন্ডারিতে সাজানো ছিল তাঁর ইনিংস। শেফালি ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়।

শেফালি ও স্মৃতি মান্ধানা শুরুতে ১০৪ রান জোড়েন ভারতের ইনিংসে। মান্ধানা পঞ্চাশের আগেই থেমে যান। শেফালি কিন্তু চলতেই থাকেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের বিরুদ্ধে কথা বলে শেফালির ব্যাট।  

ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন দীপ্তি। দাদা সুমিত শর্মাই ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। উত্তরপ্রদেশের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে খেলেছেন সুমিত। দাদার সঙ্গে অনুশীলনে যেতেন বোনও। 

একদিন অনুশীলনের সময় দীপ্তির কাছে চলে আসে বল। দূর থেকে তাঁর দাদার হাতে বলটি ছুড়ে দেন দীপ্তি। মাত্র ১২ বছর বয়সের বোনের হাতের জোর দেখে বিস্মিত হন দাদা। 

সেই দীপ্তি এদিনও কব্জির জোর দেখিয়ে ৫৮ রান করলেন। বল হাতে নিলেন পাঁচ-পাঁচটি উইকেট। এরকম স্বপ্নের ফাইনাল খেলতে চান সবাই। প্লেয়ার অফ দ্য সিরিজ হলেন দীপ্তি। 

বাংলার রিচা ঘোষ মনে করিয়ে দিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনির কথা। ফাইনালে মেয়ের খেলা দেখতে তাঁর মা-বাবা নবি মুম্বইয়ে। 

দেশের ক্রিকেটে উল্কার মতো উত্থান রিচার। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে উইকেটকিপার বাবার হাত ধরে মাঠে যেতেন রিচা। ধৈর্য ধরে বসে খেলা দেখতেন। সুযোগ পেলেও এক শটে মাঠের বাইরে বল পাঠাতেই পারতেন না। সেই রিচা এখন পরিণত। তাঁর পাওয়ারহিটিং দেখে মুগ্ধ নবি মুম্বইয়ের দর্শকরা। রিচা ও দীপ্তির জন্যই ভারত ২৯৮ রান করল শেষমেশ। 

এই ২৯৮ রান তাড়া করতে নেমে প্রোটিয়া অধিনায়ক লরা উলভার্ট সেঞ্চুরি হাঁকালেন। তিনি যখন ম্যাচের উপরে ছায়া বিস্তার করতে শুরু করেছেন, তখনই ইন্দ্রপতন। ১০১ রানে ফিরলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। একটু একটু করে ভারতের ক্যাম্পের দিকে হেলতে থাকা ম্যাচ তার পরই ঢুকে গেল ভারতের সাজঘরে। বাকিরা সেভাবে আর লড়াই করলেন কোথায়! দক্ষিণ আফ্রিকা উইকেট হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে আস্কিং রেট। ক্যাচ পড়ে একাধিকবার। কিন্তু দিনটা যে ছিল ভারতের। দিনান্তে নবি মুম্বইয়ে বেজে উঠল, 'মা তুঝে সালাম।'