পুজো পার হয়ে গরম-বৃষ্টি সরে গেলে, শহরকে ঘিরে ধরে ঝুপ করে নেমে আসা হালকা ঠান্ডা—আর সেই সঙ্গে মনেও নামে একটুখানি শূন্যতা। উৎসবের মেজাজে যেন হঠাৎ বিরতি। তবে এখন আর সে মনখারাপের দিন নেই! নেটফ্লিক্স-প্রাইমের যুগে কলকাতা নিজেই বানিয়ে নিয়েছে নতুন উৎসব—‘হ্যালোইন’। পাশ্চাত্যের মাটি থেকে জন্ম নিলেও, এখন এই উৎসবের ‘ভূতুড়ে’ হাওয়া পৌঁছে গিয়েছে কলকাতার অলিগলি থেকে তলপেটের কফিশপ পর্যন্ত।

নয়ের দশকের ‘ফ্রেন্ডস’ থেকে শুরু করে আজকের ‘বিগ ব্যাং থিওরি’ বা ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’— প্রায় সব জনপ্রিয় আমেরিকান সিরিজেই হ্যালোইনের ছোঁয়া অনিবার্য। আর ওটিটির সৌজন্যে সেই বিদেশি উৎসব এখন পৌঁছে গিয়েছে কলকাতার অলিগলি, এমনকি ছাদবাগানের পার্টিতেও। আলো-আঁধারিতে সাজানো ঘর, কুমড়ো-সদৃশ লণ্ঠনের ম্লান আলো, অদ্ভুত পোশাকে সেজে ওঠা—ভয়ের সঙ্গে মজার এই মেলবন্ধনেই এখন শহর মাতোয়ারা। তবে প্রশ্ন একটাই—পাশ্চাত্যের এই ‘হ্যালোইন’ কি আদৌ মানায় বাঙালির সংস্কৃতিতে? আমাদের নিজস্ব ভূতচতুর্দশীর মাটির গন্ধ আর লোককথার ভয়ের সঙ্গে এর পার্থক্য কতটা? আর এই আমদানি করা উৎসবের প্রভাব পড়ছে কি শিশুদের কোমল মনে—নাকি এ কেবলই এক নতুন প্রজন্মের আনন্দের উপলক্ষ?

মনোবিদ রিঙ্কু পাঠকের মতে, উৎসব মানেই আনন্দ—তা সে দেশীয় হোক বা বিদেশি, উদযাপনে কোনও ক্ষতি নেই। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে সব উৎসবই হওয়া উচিত অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে। কারণ ছোটরা সহজেই প্রভাবিত হয়, আর যদি তাদের একা ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে আনন্দ আর আতঙ্কের সীমারেখা গুলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অভিভাবকের উপস্থিতি সেই জায়গায় একরকম মানসিক নিরাপত্তা তৈরি করে। তাঁর কথায়, “না জেনে কোনও কিছুর অংশ হওয়া শিশুদের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। চারপাশে যা হচ্ছে, তা-ই করলে আনন্দ—এই ধারণা ছোটরা গড়ে তোলে আশপাশের প্রাপ্তবয়স্কদের দেখেই। তাই অভিভাবকদেরই আগে বুঝতে হবে, সন্তানকে তারা ঠিক কোন অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত করাচ্ছেন। উৎসবের ক্ষেত্রেও বিষয়টা আলাদা নয়। শুধুমাত্র অংশ নেওয়া নয়, কেন অংশ নিচ্ছে তা জানলে শিশুরা সহজেই যে কোনও নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারে।”

মনে করা হয়, প্রায় দু’হাজার বছর আগে প্রাচীন আয়ারল্যান্ডে সেল্ট জাতি গ্রীষ্মের শেষে এবং শীতের শুরুতে ‘সাওইন’ নামে এক উৎসব পালন করত। তাদের বিশ্বাস ছিল, ৩১ অক্টোবরের রাতে জীবিত ও মৃতের জগতের সীমানা মুছে যায়, মৃত আত্মারা নেমে আসে মানুষের মাঝে। সেই আত্মাদের দূরে রাখতে মানুষ জ্বালাত আগুন, মুখোশ পরত পশুর চামড়া, আর দেবতাদের উদ্দেশ্যে ফসল উৎসর্গ করত। ভয়, শ্রদ্ধা আর আনন্দ মিশে তৈরি হত এই উৎসব। পরে খ্রিস্টধর্ম ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে ১ নভেম্বরকে ‘অল সেন্টস’ ডে’ বা ‘অল হ্যালোজ ডে’ ঘোষণা করা হয়— আর তার আগের রাত, ‘অল হ্যালোজ ইভ’, সময়ের সঙ্গে রূপ নেয় আজকের হ্যালোইনে।

বিদেশি উৎসব ঘিরে এমন নানা কাহিনি অনেকের মনেই জন্ম দেয় ভয় মেশানো কৌতূহল। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের উদযাপন যদি বোঝার বাইরে চলে যায়, তা শিশুদের মনে অন্ধবিশ্বাস বা ভুল ধারণার বীজও বপন করতে পারে। রিঙ্কুর কথায়, “মা-বাবা আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল হলেই অনেক সময় তাঁরা সন্তানদের আনন্দ দিতে এই ধরনের উদযাপনে মেতে ওঠেন। এতে কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু তাঁদের সন্তানকে বোঝাতে হবে হ্যালোইনও আর পাঁচটা উৎসবের মতোই। আলাদা কিছু নয়। শিশু-মনে যদি এই ধরনের উৎসবকে নিয়ে কোনও কুসংস্কার গড়ে ওঠে, বা এটিকে অতিপ্রাকৃত কিছু ভাবতে শুরু করে তাহলে তার নেতিবাচক প্রভাব তার উপর পড়বেই। তাই শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনার সঞ্চার করতে হবে।”

ভূত চতুর্দশী আর হ্যালোইন দুই দেশের দুই উৎসব হলেও, দু’টিকে একসূত্রে দেখছেন মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, এদের মধ্যে পার্থক্যের চেয়ে মিলই বেশি। হ্যালোইন নিয়ে মাতামাতিতে কোনও ক্ষতি দেখছেন না তিনি, বরং এটিকে দেখছেন শেখার সুযোগ হিসাবে। অনিন্দিতার কথায়, “শিশুরা যত অন্য দেশের সংস্কৃতি ও উৎসব সম্পর্কে জানবে, তাদের চিন্তা তত উদার হবে। কৌতূহল বাড়বে, মানসিক বিকাশও তত গভীর হবে। আজকের যুগে পৃথিবীর নানা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়াই তাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পরিস্থিতি তারা খাপ খাওয়াতে পারবে। নিজেকে সকলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে।”

তবে ছবিটা একেবারে একপেশে নয়। অনিন্দিতার মতে, হ্যালোইনের মতো উৎসবের অতিরিক্ত উন্মাদনা শিশুদের রোজকার জীবনের ছন্দে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটার মতো ধারাবাহিক উৎসবের পর আবার নতুন সাজ, নতুন উৎসব—এই নিরন্তর উদযাপনের ভিড়ে শিশুরা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে সরে যেতে পারে, পড়াশোনা ও বিশ্রামের মতো অভ্যাসেও প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি। 

বর্তমান সময়ে বিদেশি উৎসবের প্রতি শিশুদের আকর্ষণ সত্যিই চোখে পড়ার মতো। হ্যালোইনের দিন সকাল থেকেই কলকাতার নানা প্রান্তে চলছে সাজগোজ, ছবি তোলা আর উৎসবের রেশ। ছোটরা কেউ ড্রাকুলার পোশাকে, কেউ বা ভূতের সাজে মেতে উঠেছে আনন্দে। তবে এই বিদেশি রঙের উচ্ছ্বাসে যেন তারা নিজের সংস্কৃতির শিকড় না হারায়—সেই সতর্কবার্তাই দিয়েছেন মনোবিদেরা। তাঁদের মতে, বিশ্বসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া ভাল, কিন্তু নিজের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংযোগ বজায় রাখাটাই সবচেয়ে জরুরি।

অনিন্দিতার কথায়, “এই বিদেশি উদযাপনের কারণে অনেক সময় শিশুদের নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক কমে যায়। সেটিকে তারা আর সমান আনন্দদায়ক হিসাবে ভাবতে পারে না। সেটা যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।”

শেষমেশ বোঝা যাচ্ছে, হ্যালোইনের ভূত এসে পড়েছে বাঙালির দরজায়ও। তবে যতই বিদেশি মুখোশে সাজুক শহর, মনে রাখতে হবে— ভূত চতুর্দশীর ভূতদেরও কিন্তু ‘রিল’-এর দরকার নেই, তারা বরাবরই ঘরোয়া আর খানিক পরিচিতও বটে!
সংস্কৃতির মেলবন্ধনে উৎসব হোক আনন্দের, কুসংস্কারের নয়—এই তো আসল ম্যাজিক!