শুধু কলকাতা নয়, এখন বেঙ্গালুরুর দুর্গাপুজো মানেও থিমের ঘনঘটা। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বারোয়ারি পুজোগুলি এ বারও তাঁদের ভাবনায় একে অপরকে টেক্কা দিতে প্রস্তুত। কোথাও সাবেকিয়ানার সঙ্গে মিশেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, তো কোথাও আবার কর্ণাটকের লোকশিল্পের সঙ্গে বাংলার ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটছে। আর এই সব পুজোকে সম্মান জানাতে বেঙ্গালুরুতে হাজির আজকাল ডট ইন। প্রথমবার আয়োজিত হতে চলেছে আজকাল ‘শারদ গৌরব’-এর আসর। একেবারে অনন্য থিম, শিল্পকলা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে দর্শকদের মাতিয়ে তুলতে প্রস্তুত। শারদ গৌরব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য মোট চল্লিশটি পুজো কমিটি আবেদন পাঠিয়েছিল। তাদের মধ্যে সেরা ১০ পুজো বাছাই করা হয়েছে। এবার শুরু হবে মূল প্রতিযোগিতা। মোট বিজয়ীসংখ্যা হবে পাঁচ।  প্রতিযোগিতার বিচারক তথা অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত ঘুরেফিরে দেখে ফলাফল ঘোষণা করবেন মহাষষ্ঠীতে।  মহাসপ্তমীর আবহে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে শারদ গৌরব সম্মান।  আসুন, এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বেঙ্গালুরুর বাছাই করা সেরা ১০ পুজোগুলির থিম।

 


১) ঐকতান হেব্বাল কালচারাল সোসাইটি 

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐকতান হেব্বাল কালচারাল সোসাইটি বেঙ্গালুরুয়ের অন্যতম প্রধান বাংলা কমিউনিটি সংস্থা। তারা দুর্গাপুজো উদযাপনের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা–র জন্য পরিচিত।

২০২৫ সালের থিম: গীতা

এই বিশ্বখ্যাত গ্রন্থের থিমটি এবারের পুজোতে তুলে ধরার জন্য সকলের প্রত্যাশা। সংস্থার প্রার্থনা, দর্শকদের কাছে এই থিমের একটি নতুন দৃষ্টিকোণ ও অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরার।

 

২) আরটি নগর

এবারের আরটি নগর দুর্গাপুজো মুক্তি থিমকে কেন্দ্র করে, যা শুধুমাত্র মহিষাসুরের পরাজয় নয়, বরং ভয়, অন্যায় এবং অন্ধকার থেকে মুক্তি–এর প্রতীক। মুক্তি থিমটি জ্ঞান, আশা এবং শক্তি–তে প্রাপ্ত মুক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। যেভাবে মা দুর্গা আমাদের জীবনে আলো নিয়ে আসেন, ঠিক তেমনিভাবে এই থিম সকলকে মনে করিয়ে দেবে যে সত্যিকার মুক্তি রাজনৈতিক বা সামাজিক নয়, বরং আধ্যাত্মিক ও ব্যক্তিগতও।

 

৩) জয়মহল কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন :

১৯৫৫ সালে বেঙ্গালুরুতে স্থানান্তরিত বাংলা সরকারি কর্মচারীদের উদ্যোগে শুরু হয়। আজ ২০২৫–এও তারা প্রতিবছর তাদের ঐতিহ্য এবং উৎসবের আত্মা সংরক্ষণ করে আসছে।

থিম: হারানো শৈশব
এটি ২০২৫ সালের ডিজিটাল ও এআই যুগে শৈশবের সরল আনন্দ ও স্মৃতিকে স্মরণ করানোর প্রচেষ্টা।


৪) গ্রিন গ্লেন লেআউট :

বেল্লান্দুর দুর্গাপুজো এবারের থিম আনন্দ তাণ্ডব, যা ঋগ্বেদ এবং হিন্দু দর্শনের চক্রাকার নীতির অনুপ্রেরণায় তৈরি।

দুর্গামূর্তিটি নৃত্যমুখী অবস্থানে, যা সৃষ্টি, রক্ষণ এবং ধ্বংসের ভারসাম্য প্রকাশ করে।

মণ্ডপসজ্জা দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের স্থাপত্য শিল্পকে প্রতিফলিত করে।

চন্দননগরের আলোর ব্যবহার থিমে দৃশ্যমান নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

 


৫) ইস্ট বেঙ্গল কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন :

এবারের পুজো তাদের ৮ম বার্ষিকী, থিম অনন্ত শক্তি —মায়ের নয়টি রূপের প্রতিফলন।

মা দুর্গা এখানে ভক্তি, সাংস্কৃতিক একতা এবং সীমাহীন শক্তির প্রতীক।

পটচিত্র শিল্পের মাধ্যমে প্রতিটি প্যান্ডালের দেয়ালে গল্প বলা হবে।

 


৬) বর্ষা

২০২৫–এ বর্ষার ১০ম দুর্গাপুজো, থিম চিত্রঘন। এই থিম আদতে যক্ষাঘন-র অনুপ্রেরণায় তৈরি যা আসলে কর্ণাটকের লোকনাট্য শিল্প। যা আমাদের ভারতীয় গল্প বলাকে তুলে ধরে অনন্যভাবে। কলকাতার মণ্ডপ স্ট্রাকচারের গ্ল্যামার এবং বর্শার প্যাট্রন, পটচিত্র, ছাউ মুখোশ, ডলু কুণিথা, সিনেমা-প্রেরিত উপাদান—সব মিলিয়ে সাংস্কৃতিক ফিউশন হতে চলেছে এই মণ্ডপ। কন্নড় এবং বঙ্গ সংস্কৃতির সমন্বয় বহন করবে এবারের এই পুজোর প্রতিমা।


৭) সারথি সোশিও কালচারাল ট্রাস্ট

কোরামাঙ্গালায় ২০০৩ থেকে পুজো উদযাপন। এবারে তাদের থিম ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’।

থিমটি সাংস্কৃতিক, বিভিন্ন প্রজন্ম এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির প্রতীক।

শিল্প ও সঙ্গীতের মাধ্যমে মেলবন্ধনের বার্তা দেবে এই পুজো।

 


৮) নর্থ বেঙ্গালুরু কালচারাল সমিতি 

 

১৯৭৮ সালে রাজাজিনগরের বাংলা পরিবারগুলোর উদ্যোগে শুরু।

থিম: চতুরঙ্গ – দাবার জগৎ। 

জীবন, কৌশল এবং নৈতিক জ্ঞানকে দাবার খেলার মাধ্যমে প্রতিফলিত করা হয়েছে।

২০,০০০–এর বেশি দর্শনার্থী আসেন এই মণ্ডপে।

 

৯) বেঙ্গলি ইন বেঙ্গালুরু 

১৫ম বার্ষিকীতে এবারে তাদের থিম: ঐতিহ্যের আঙিনায় ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো। 

কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির স্মৃতি ও সাংস্কৃতিক স্বর্ণযুগের আবেশ।

পটচিত্র, আলপনা, বাঙালি হস্তশিল্প ও সঙ্গীতের এক মিশ্র অভিজ্ঞতা বহন করবে এই মণ্ডপ।

 

১০) দ্য বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন

৭৫ বছর পূর্ণ, শুরু ১৯৫০ সালে। এবারে তাদের থিম সোভাবাজার রাজবাড়ি।

ইতিহাসে বড় মাইলফলক: ১৯৬১–এ রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপন, ১৯৬৮–এ বার্ষিক মৈত্রী সূচনার, ১৯৭৭–এ ট্যাগোর কালচারাল সেন্টার।

বেঙ্গালুরুতে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কমিউনিটি একত্রিত করার প্রতীক।


বেঙ্গালুরুর ২০২৫ সালের দুর্গাপুজো শুধু উৎসব নয়, বরং ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিল্প এবং কমিউনিটির মিলন। প্রতিটি পুজো অদ্বিতীয় থিম, শিল্পকলা এবং গল্প বলার মাধ্যমে দর্শকদের মুগ্ধ করবে, যা শহরের বাংলা সম্প্রদায়ের শক্তি এবং ঐতিহ্যের প্রতিফলন।