এক সময় যেটিকে মনে করা হত বয়সকালের রোগ, সেই কোলন ক্যানসার এখন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে তরুণদের মধ্যেও। ২০, ৩০ এবং ৪০-এর কোঠার মানুষও আক্রান্ত হচ্ছেন এই প্রাণঘাতী রোগে। বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকেরা তাই সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। কেবল বিদেশেই নয়, ভারতেও দ্রুত বাড়ছে কোলন ক্যানসারের তরুণ রোগীর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, পরিবেশগত দূষণ ও জিনগত কারণ মিলিয়ে যেন এক ‘পারফেক্ট স্টর্ম’ তৈরি হয়েছে, যার ফলেই এত অল্প বয়সে দেখা দিচ্ছে কোলন ক্যানসার।
জীবনযাত্রার প্রভাব
সার্জিক্যাল অনকোলজির চিকিৎসক মন্দীপ সিং মলহোত্রা বলেন, “আমাদের খাদ্যাভ্যাসে বড় পরিবর্তন এসেছে। এখনকার খাবারে প্রক্রিয়াজাত এবং অতিপ্রক্রিয়াজাত খাদ্যের আধিক্য, যাতে চিনি ও অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট বেশি, কিন্তু ফাইবারের পরিমাণ অত্যন্ত কম। এই পরিবর্তনই কোলন ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ।”
এর পাশাপাশি শারীরিক অনুশীলনের অভাব, মানসিক চাপ এবং স্থূলতার বৃদ্ধি দেহে প্রদাহ তৈরি করে এবং বিপাকীয় ভারসাম্য নষ্ট করছে। চিকিৎসক কুমারদীপ দত্ত চৌধুরী বলেন, “তরুণ প্রজন্ম আজ বেশি ফাস্টফুড, রেড মিট ও চিনিযুক্ত পানীয় খায়। অথচ ফল, সবজি বা ফাইবারযুক্ত খাবার কম খায়। এতে অন্ত্রের স্বাস্থ্য নষ্ট হয় ও প্রদাহ বেড়ে যায়।”
গাট মাইক্রোবায়োম বা অন্ত্রের জীবাণুসমূহের ভূমিকা
নতুন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আমাদের অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম বা জীবাণুসমূহের ভারসাম্য কোলন ক্যানসারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং পরিবেশ দূষণ এই জীবাণুসমূহের ভারসাম্য নষ্ট করে প্রদাহ সৃষ্টি করে।
ডাঃ মলহোত্রা বলেন, “আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাদ্যাভ্যাস একসময় অন্ত্রের জীবাণুদের ভারসাম্য রক্ষা করত, কিন্তু আধুনিক খাবার সেই ভারসাম্য নষ্ট করছে।”
আর্টেমিস হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডাঃ তপন সিং চৌহান জানান,
“গাট মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্য নষ্ট হলে শরীর প্রদাহ ও টক্সিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যা ক্যানসারের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”
পরিবেশ এবং জিনগত কারণ
খাবার, জল ও বাতাসে থাকা রাসায়নিক দূষণও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রায় ১৫-২০ শতাংশ কোলন ক্যানসার বংশগত। তাই যাঁদের পরিবারে এই রোগের ইতিহাস আছে, তাঁদের উচিত অল্প বয়স থেকেই নিয়মিত স্ক্রিনিং করা।
দেরিতে শনাক্ত হওয়ার ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞদের মতে, তরুণ বয়সে রোগ শনাক্ত না হওয়ার অন্যতম কারণ হল সচেতনতার অভাব।
ডাঃ চৌহান বলেন, “অনেকে প্রাথমিক লক্ষণ যেমন মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন, রক্তপাত বা অজানা কারণে ওজন কমে যাওয়া—এসব উপেক্ষা করেন। ফলে রোগ অনেকটা এগিয়ে যায়।”
প্রতিরোধই সেরা উপায়
চিকিৎসকদের একবাক্যে মত—কোলন ক্যানসার এখন আর কেবল বয়স্কদের রোগ নয়।
ঝুঁকি কমাতে তাঁরা যে পরামর্শ দিচ্ছেন:
ফাইবার, ফল ও সবজিতে সমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন
রেড মিট এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খান
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
তামাক ও অ্যালকোহল পরিহার করুন
পরিবারে ইতিহাস থাকলে সময়মতো স্ক্রিনিং করান
জিনগত কারণ বদলানো না গেলেও জীবনযাত্রা বদলে এবং সচেতনতা অবলম্বন অনেকটা ঝুঁকি কমানো সম্ভব। ক্রমবর্ধমান তরুণদের কোলন ক্যানসারের প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন— সচেতনতা, সতর্কতা এবং সময়মতো ব্যবস্থা-ই হতে পারে এই নীরব সংকটের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ।
