আজকাল ওয়েবডেস্ক: আমেরিকার অভিবাসন নীতি নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। কিন্তু সম্প্রতি কনজারভেটিভ অ্যাক্টিভিস্ট চার্লি কার্ক এবং ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডি-স্যান্টিস যে সুরে ভারতীয় পেশাজীবীদের ভিসা ইস্যুতে সরব হয়েছেন, তা আবারও এক জটিল প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে—আমেরিকা কি সত্যিই বিদেশি প্রতিভায় ভরে গেছে, নাকি এ বক্তব্য নিছক ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির প্রতিধ্বনি? আমেরিকান দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে অভিবাসন সবসময়ই উত্তেজনাকর ইস্যু। মেক্সিকো সীমান্ত থেকে শুরু করে মুসলিম ভিসা নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত—প্রতিবার নির্বাচনী মৌসুমে এই তাস খেলা হয়। এবার নিশানায় পড়েছেন ভারতীয় পেশাজীবীরা। কার্কের ভাষায়, “আমেরিকার আর ভারতের মানুষদের জন্য ভিসার দরকার নেই। আমরা ভরে গেছি।” একই সুরে ডি-স্যান্টিস বলেছেন—H-1B ভিসা নাকি প্রতারণা, যা আমেরিকানদের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই অভিযোগ কতটা তথ্যসম্মত, আর কতটা রাজনৈতিক কৌশল?
আমেরিকার প্রযুক্তি খাত, বিশেষত সিলিকন ভ্যালি, আজ যেখানেই দাঁড়িয়ে—তার বড় অংশ ভারতীয় পেশাজীবীদের অবদানে। গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাডোবি থেকে শুরু করে শতাধিক স্টার্টআপ—প্রধান নির্বাহী পদে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের উপস্থিতি আর কেবল কাকতালীয় নয়, এটি এক প্রবণতা। হাজার হাজার ভারতীয় ছাত্র মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসেন। তাঁদের টিউশন ফি শুধু শিক্ষা খাতে অর্থ ঢালে না, বরং গবেষণা ও উদ্ভাবনের ভিত্তি মজবুত করে। পড়াশোনা শেষ হলে তাঁরা যে জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে আমেরিকার শিল্প ও প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যান, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
আরও পড়ুন: গোল গোল ফোলা ফোলা টমেটো নিয়ে খেলা, শরীর লালে লাল করে এই দেশের রাস্তায় ভারতীয়রা যা করলেন
ডি-স্যান্টিসের অভিযোগ—H-1B ভিসা আমেরিকানদের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে। বাস্তবে আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিল-এর গবেষণা বলছে উল্টো কথা। অভিবাসী কর্মীরা দেশীয় কর্মীদের বিকল্প নন, বরং পরিপূরক। তাঁরা নতুন ব্যবসা শুরু করেন, কর দেন, স্থানীয় অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—H-1B ভিসাধারীরা বেকারভাতা বা সামাজিক সুরক্ষার কোনো সরকারি সুবিধা পান না। অথচ তাঁরা বছরে কোটি কোটি ডলার কর রাজস্বে অবদান রাখেন। এ তথ্য প্রমাণ করে, তাঁরা কেবল “চাকরি কেড়ে নেওয়া বিদেশি” নন, বরং অর্থনীতির সক্রিয় চালিকাশক্তি। “আমেরিকা ভরে গেছে”—বাস্তবতা না রাজনীতি? আমেরিকা সত্যিই কি “ফুল” হয়ে গেছে? না। তথ্য বলছে, দক্ষ কর্মীর ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছে। স্বাস্থ্যসেবা, গবেষণা, প্রযুক্তি, কৌশল—প্রায় সব ক্ষেত্রেই যোগ্য পেশাজীবীর প্রয়োজনীয়তা মেটাতে দেশীয় শ্রমশক্তি যথেষ্ট নয়।
অন্যদিকে, সীমাহীন প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা চলছে চীন, ইউরোপ, কানাডার সঙ্গে। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আন্তর্জাতিক প্রতিভাকে স্বাগত জানানো ছাড়া বিকল্প নেই। কানাডা ইতিমধ্যেই এই সুযোগ নিচ্ছে। ভারতীয় প্রতিভা সীমিত হলে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আর কানাডা বা ইউরোপ এগিয়ে যাবে। তাহলে কেন এই কণ্ঠস্বর? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির কারণে চাকরির পরিবর্তন, এবং তরুণ প্রজন্মের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ—এসবের সহজ উত্তর খুঁজে নিতে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি দোষ চাপাচ্ছে বিদেশিদের ঘাড়ে। ভারতীয়রা এখানে সহজ নিশানা, কারণ তাঁদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য এবং তাঁরা দৃশ্যমানভাবে প্রযুক্তি খাতে প্রভাবশালী।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সমস্যার মূলে রয়েছে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ঘাটতি। অভিবাসীদের নিষিদ্ধ করলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। বরং আমেরিকা আরও পিছিয়ে পড়বে। চার্লি কার্ক বা রন ডি-স্যান্টিসের বক্তব্যে আবেগ আছে, ভোটের সমীকরণ আছে, কিন্তু তথ্যের ভিত্তি নেই। ভারতীয় পেশাজীবীরা আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়—তাঁরা অংশীদার। তাঁদের অবদান ছাড়া আমেরিকার উদ্ভাবনী শক্তি অর্ধেকই হয়ে যেত। সুতরাং প্রশ্নটি আসলে দাঁড়াচ্ছে—আমেরিকা কি নিজেকে গুটিয়ে রেখে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে, নাকি বৈচিত্র্য ও প্রতিভাকে আলিঙ্গন করে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব ধরে রাখবে?
