আজকাল ওয়েবডেস্ক: সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং নীতি আয়োগ দাবি করেছেন, ভারত এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি, জাপানকে টপকে গেছে। এই দাবি তারা করছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর ২০২৫ সালের শেষের অনুমান অনুযায়ী। কিন্তু বাস্তবে এই ব্যবধান এতটাই ক্ষীণ — মাত্র ৫৮৬ মিলিয়ন ডলার বা ০.০১৪ শতাংশ — যে এখনই জয়ধ্বনি তোলা, বিশেষ করে সন্দেহজনক জিডিপি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে, যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ।
তাহলে এই আগবাড়িয়ে সাফল্য ঘোষণার কারণ কী? এটা কি ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর ইমেজ রক্ষার চেষ্টা? আন্তর্জাতিকভাবে অনেকেই মনে করছেন, ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতীয় মুখপাত্রের আগেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করে দেন — যা এই ধারণাকে জোরালো করে।
অর্থনীতি বড় হলেও সাধারণ মানুষের জীবনে তার কী প্রভাব? ২০২৫ সালে ভারতের জনসংখ্যা হতে চলেছে আনুমানিক ১.৪৬ বিলিয়ন, যেখানে জাপানের জনসংখ্যা মাত্র ০.১২৩ বিলিয়ন। অর্থাৎ একই জিডিপি হলেও, এক জন জাপানির গড় আয় এক জন ভারতীয়র তুলনায় বারো গুণ বেশি। বর্তমানে মাথাপিছু জিডিপির দিক থেকে ভারতের স্থান ১৪০তম, আর জাপানের ৩৪তম।
উপরন্তু, ভারতে আয়বৈষম্য প্রবল। জাপানে শীর্ষ ১ শতাংশ আয় উপভোগ করে ৮.৪৪ শতাংশ, ভারতে সেটা ২২.৬ শতাংশ। নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের ভাগ জাপানে ২০ শতাংশ, ভারতে মাত্র ১৫ শতাংশ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নাগরিক পরিকাঠামো, প্রযুক্তি—সব ক্ষেত্রেই জাপান অনেক এগিয়ে।
চাকরির ক্ষেত্রেও পার্থক্য স্পষ্ট। জাপানে শ্রমশক্তি অংশগ্রহণ হার ৬৩ শতাংশ, ভারতে তা সরকারি হিসেবে ৫৬ শতাংশ, কিন্তু CMIE এবং ILO অনুযায়ী সেটা অনেক কম। বিশেষ করে নারী এবং শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে কর্মসংস্থান আরও কম।
অসংগঠিত খাত — কৃষক, ছোট ব্যবসা, মাইক্রো-উদ্যোগ — নানা ‘সংস্কার’-এর চাপে ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত। নোট বাতিল, ভুলভাবে রূপায়িত GST এবং জোর করে ডিজিটালিকরণ এই খাতকে বিপন্ন করে তুলেছে। সরকার বরং মূলধন-নির্ভর পরিকাঠামো প্রকল্পে বেশি ব্যয় করছে, যা কর্মসংস্থান কম করে। বিপরীতে, মনরেগা, শিক্ষা বা গ্রামীণ উন্নয়নের মতো খাতে বরাদ্দ কমেছে।
সরকারের ‘দারিদ্র্য হ্রাস’ দাবি বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ২০১৫–১৬ এবং ২০১৯–২১ সালের NFHS ডেটার ভিত্তিতে যে ‘মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি’-র হিসাব, তা মহামারির সময়কার বাস্তবতা প্রতিফলিত করে না। পাশাপাশি, এখনও পর্যন্ত ২০০৪–০৫ সালের তেন্ডুলকর কমিটির দারিদ্র্যসীমাই বহাল — যা যুগোপযোগী নয়।
বর্তমান ডলারের মান অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য সীমা — দিনে মাথাপিছু ২.১৫ ডলার — ভারতীয় মুদ্রায় দিনে ১৮৩ টাকা। এক পরিবারে গড়ে ৫ জন ধরলে, মাসে ২৭,৪০০ টাকার নিচে আয় মানেই দারিদ্র্যসীমার নিচে। এই হিসাবে ভারতের ৯০ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে।
‘পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি’ বা PPP ভিত্তিক দারিদ্র্য হিসাব, যা ধনীদের জীবনযাত্রাকে ব্যাখ্যা করে, গরিবদের বাস্তবতা ঢেকে দেয়। তাই আসল অবস্থা জানতে ডলারের নমিনাল মানেই দারিদ্র্য পরিমাপ হওয়া উচিত।
সবশেষে, জিডিপি পরিমাপেও রয়েছে পদ্ধতিগত ত্রুটি। অসংগঠিত খাতের পরিসংখ্যানের অভাবে সংগঠিত খাতের উপাত্ত ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ২০১৬-র পর থেকে অর্থনীতির বাস্তব চিত্রকে বিকৃত করে। সেই কারণে জিডিপির বৃদ্ধির হার, বিনিয়োগ ও ভোগ পরিসংখ্যানও ভুল।
সুতরাং, শুধুমাত্র IMF-এর অনুমান ধরে ‘বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি’ হিসেবে ভারতের দাবিকে অনেকেই ফাঁপা সাফল্য হিসেবে দেখছেন। বাস্তবতা না মেনে, শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক মর্যাদার খাতায় নাম লেখালে দেশের সাধারণ মানুষদের জন্য খুব একটা লাভ নেই।
