সব্যসাচী মজুমদার 

প্রত্যেকটি আখ্যান, অন্তত, আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির আখ্যান শেষ পর্যন্ত একজন বোড়ের কথাই বলে। যার অস্তিত্বের একমাত্র স্পন্দন বলতে লড়াই আর কেবলই লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত। মনোজ মিত্র রচিত, অভি চক্রবর্তী নির্দেশিত, সম্পাদিত ও সংযোজিত 'আবার বাঞ্ছার ' ফলিং একশনের শীর্ষ বিন্দুতে সেই বার্তার দ্যুতিই পেলেন দর্শক গত আঠাশে অক্টোবর, বনগাঁ নীলদর্পণ মঞ্চে।

একটি বিরাট মাপের বোড়ে কোলে বাঞ্ছা দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে আর আবহে শিশুর কান্না বেজে চলেছে—তুঙ্গ শিহরণ তৈরি করে দর্শকের কাছে আজকের ভারতবর্ষের একটি নিপুণ ও অনিবার্য ছবি তুলে ধরলেন অভি ।

মনোজ মিত্র রচিত বাঞ্ছা একটি কাল্ট চরিত্র। নাটক‌ও বটে। বাঙালি জনজীবনে একটি মিথে পরিণত হয়েছে বাঞ্ছা — এ কথা বললে অত্যুক্তি হয় না। অত্যুক্তি হয় না এই কারণেই, বাঞ্ছা চরিত্রের নির্মাণ ঘটেছে যে দ্বন্দ্বের প্ররোচনায়, সেই দ্বন্দ্ব এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং এই প্রাসঙ্গিকতা আগামী অনেক সময় ধরেই প্রলম্বিত হবে বলেই অনুমিত হয়। কেননা, ঐতিহ্য সচেতনতার সঙ্গে মূল্যবোধ বিবর্তনের যে পরস্পরমুখীতা তা তো আসলে ঐতিহ্যের নতুন অঙ্গরাগ নির্মাণ করতে সহায়তা করে। কিন্তু এই নির্মাণের পদ্ধতিটি যে অপরিমাণ দুঃসহ তার নিবিড় উদাহরণ বাঞ্ছা।

বাঞ্ছারামের গল্প আমরা সকলেই জানিই। এ স্থলে তাকে বিশদ করা অতিকথন হয়ে যাবে। বরং আমরা যদি নাটকের মূল আখ্যানকে প্রসঙ্গ থেকে সরিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে রাখি অভি চক্রবর্তীর প্রয়োগকে,তবে, সর্ব প্রথমে তিনি ধন্যবাদার্হ নাটকের শুরুতেই একটি অপার্থিব আবহাওয়া গড়ে তোলার জন্য। আবহ, আলো এবং স্যুররিয়ালিস্টিক কোরিওগ্রাফি — সব মিলিয়ে একটি উপযুক্ত প্রতিবেশ নির্মাণ করে দর্শককে বুঝিয়ে দেয় যে অতঃপর তাঁরা প্রবেশ করতে চলেছেন এমন একটি আখ্যানবৃত্তে যা লোক আর লোকাতীতের স্পর্শ - অস্পর্শের মধ্যে ঘোরাফেরা করবে।

এবং সেই সূত্র ধরেই এগিয়েছে 'আবার বাঞ্ছা '। আখ্যানের ভঙ্গিকে দাবি অনুযায়ী তৈরিও করেছেন নাট্যমুখের অভিনেতারা। কিন্তু, মূল চিন্তাটি দানা বাঁধে যখন ধীরে বাঞ্ছার ভঙ্গি আরোপিত হতে থাকে জমিদারের ওপর আর বাঞ্ছা আড়ষ্টতা ভেঙে হয়ে উঠতে থাকে জরাহীন অস্তিত্ব, দর্শকের ধাঁধা লাগে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে অস্বস্তিতে রাখে। তারপর নাটকের শেষ মুহূর্তে বোড়ের প্রসঙ্গ এসে মিলিয়ে দেয় চিন্তার উচ্চাবচতাকে। মূল টেক্সটের বাইরে গিয়ে অভি'র এই সংযোজন, তাঁকে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন করে তোলে। দু'টি চরিত্রের এরকম পারস্পরিক আরোপন অভিনব তো বটেই এক‌ইসঙ্গে অভিনয়ের ক্ষেত্রেও একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। জমিদার এবং বাঞ্ছা — উভয় চরিত্রের অভিনেতাকে‌ই একটি দুরূহ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। চরিত্রের টেক্সট নির্দেশিত প্রবহমানতা বজায় রাখতে রাখতে বিবর্তিত হতে হয়েছে নিজেদের মতো করে। আর তার ফলেই এক‌ইসঙ্গে দুই অভিনেতাকেই সাধুবাদ জানাতে হয়। 
এখন, জমিদার বাঞ্ছার শারীরিক সংকটগুলি যখন আয়ত্ব করছেন আর বাঞ্ছা যখন আয়ত্ব করছে জমিদারের শারীরিক সাবলীলতা, তাঁদের মনস্তত্ত্বকে কিভাবে দেখছেন নির্দেশক ? না, চিহ্নের বদল তো হয় না। তাই নিজস্ব চিহ্ন বজায় রেখেই সাবলীলতা অর্জন করে বাঞ্ছার মাধ্যমে নাটককার আমাদের বোঝান যে অফুরন্ত লড়াইও ফুরোয় না আর ফুরোয় না সেই লড়াইয়ের যোদ্ধারাও। অসম লড়াইয়ে হারতে হারতেও আবার ফিনিক্সের মতো ফিরে আসাই তাঁদের নিয়তি।

আর এই নিয়তি নির্মাণে যাঁরা ভূমিকা নিলেন, তাঁদের মধ্যে বাঞ্ছা চরিত্রের জন্য অভিনেতা শ্রী নারায়ণ গোস্বামীকে ধন্যবাদ জানাতে হয়, নিপুণ সাবললীতায় বার্ধক্য থেকে যৌবনে রূপান্তরিত হতে হতে কেবল বাঞ্ছার মনস্তাত্ত্বিক বিন্যাসকেই নয়, সামগ্রিক নাটকের বিন্যাসকেই নিয়ন্ত্রণ করলেন। শুরুর অলসপদ, ভারানত বাঞ্ছা আর শেষের যোদ্ধা বাঞ্ছার মাঝখানে যে অতিলৌকিক সেতু নির্মাণ, তার প্রতিটি অঙ্গকে সুষ্ঠু ও সংযতভাবে তৈরি করেছেন নারায়ণ বাবু। কণ্ঠের প্রয়োগ আর শরীর সঞ্চালনের উপযুক্ত যুগলবন্দী এবং কুশলী অভিনেতার পিনদ্ধ কমিক টাইমিং নারায়ণ বাবুকে এই নাটকের অস্তিত্বে পরিণত করেছে। একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতার কারু ও কৃতি দর্শকে মোহমুগ্ধ করে নিঃসন্দেহে‌ই। 

অন্যান্য ভূমিকায় রাজা গুহ, অরূপ গোস্বামী, অসীম দাস, গৌতম বসু, সুকান্ত পাল, অঞ্জন, শুভদীপ বিশ্বাস, সুপর্ণা চক্রবর্তী, রিচিক বাগচী, অভিজিৎ বণিক, সুপ্রিয় ভৌমিক, পাপিয়া ভৌমিক, শ্রেয়া সরকার এবং সংগীতা চক্রবর্তী উপযুক্ত সংগত করেছেন, বলা ভুল হবে, একটি যৌথ এডভেঞ্চারকে সুসম্পন্ন করেছেন ।

কেন যৌথ এডভেঞ্চার? এই প্রযোজনাকে, এই আলোচকের মনে হয়েছে যতটা মনোজ মিত্রের, ততটাই অভি চক্রবর্তীর‌ও। একটি অতিপরিচিত টেক্সটকে রিকনস্ট্রাক্ট করা, টেক্সটটির অন্তর্কথনকে ইমেজ এবং মূর্ত করে তোলার কূট ও দুরূহ চেষ্টাটি সম্পন্ন হয়েছে নির্দেশক এবং দক্ষ অভিনেতাদের উপযুক্ত বোঝাপড়ায়।

আলো, পোশাক এবং মঞ্চ নির্মাণও অভি চক্রবর্তীর। আলো লৌকিক জগৎ থেকে অতিলৌকিকে বিষয়কে ও দৃশ্যকে পৌঁছে দিতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। বৃষ্টির অতি উজ্জ্বল অথচ রূঢ় পতনের দৃশ্যটি ভোলার নয়। বাঞ্ছার ঘর এবং প্রেতের যাতায়াতের স্যুররিয়ালিস্টিক ব্যবহার চমৎকৃত করে। আবহে ব্যবহৃত যন্ত্রানুষঙ্গ নির্মাতার গভীর সংগীত বোধ তাকে প্রয়োগ করার ক্ষমতাকে চিনিয়ে দেয়।

শেষ পর্যন্ত একটি ভাল নাটক দেখলাম বলা যেত। কিন্তু, ওই যে অস্বস্তিটা তৈরি করে মনোজ মিত্রের চিরাচরিত শ্লেষ আর অভি চক্রবর্তীর প্রয়োগ। অস্বস্তিটা যাপনের সঙ্গে মিশে আমাদের বিমূঢ় করে রাখে। বুঝিয়ে দেয়, আমরা যারা সমাজের নীচের তলায় আমরা বাঁচি, আমাদের লড়াই শেষ হয় না। এ লড়াইয়ের হার হয় না, জিত‌ও। কেবল লড়াই আর লড়াই , আমাদের অনিঃশেষ লড়াই চলতে থাকে আবহমানের সঙ্গে। একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, নান্দনিক এবং অভিনব বিন্যাসের নাটক এই হেমন্তে আমাদের উপহার দিলেন অভি চক্রবর্তী। তাঁকে আমাদের ধন্যবাদ।