আজকাল ওয়েবডেস্ক: ফোন আপগ্রেড করেন, স্বাচ্ছন্দে থাকার জন্য বাড়িও বদল করেন, কিন্তু সঞ্চয় বাড়ানোর জন্য কী এসআইপি আপগ্রেড করেন? বহু বছর আগে পাঁচ হাজার টাকার মাসিক এসআইপি'তেই যদি আটকে থাকেন তাহলে তা বাড়নো প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারীর জন্য আসলে এই একই বিনিয়োগে থেমে থাকা নীরবে দীর্ঘমেয়াদী সম্পদের ক্ষয়।
বেতন প্রতি বছর বাড়লেও এসআইপি বিনিয়োগ বাড়ানো না হলে কী হয়, তা বোঝার জন্য IndiaToday.in ব্যক্তিগত অর্থ বিশেষজ্ঞ এবং সার্টিফাইড ফিনান্সিয়াল প্ল্যানার রিতেশ সাভারওয়ালের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, "লোকেরা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির জন্য কঠোর দর কষাকষি করে, কিন্তু তাদের এসআইপি-কেও একই হারে বাড়ানোর কথা খুব কমই ভাবেন। আর এখানেই দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ হাতছাড়া হতে শুরু করে।"
‘সেট অ্যান্ড ফরগেট’ ফাঁদ
অনেক নতুন বিনিয়োগকারীর জন্য, একটি এসআইপি শুরু করা একটি বড় আর্থিক মাইলফলক অতিক্রম করার মতো মনে হয়। আপনি এমন একটি পরিমাণ বেছে নেন যা আপনার কাছে সামলানোর মতো মনে হয়, অটো-ডেবিট চালু করেন এবং এই ভেবে আশ্বস্ত হন যে আপনি সঠিক কাজটি করেছেন। বিনিয়োগের আসল উদ্দেশ্য তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়।
পাঁচ বছর পর, বেতন বাড়ে, খরচ বাড়ে, কিন্তু এসআইপি স্থির থাকে। সাভারওয়াল ব্যাখ্যা করেন, “এই ‘সেট অ্যান্ড ফরগেট’ মানসিকতা বিনিয়োগ শৃঙ্খলার একটি মিথ্যা ধারণা। চক্রবৃদ্ধি সুদের সুবিধা তখনই সবচেয়ে ভাল কাজ করে যখন আপনার বিনিয়োগ আপনার আয়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পায়।”
যখন জীবনযাত্রার মান বাড়ে কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ে না
এই চিত্রটি প্রায় সর্বজনীন। একজন তরুণ পেশাদার মাসে ৩০,০০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন এবং ৫,০০০ টাকার একটি এসআইপি শুরু করেন। ৩০ বছর বয়সে পৌঁছানোর আগেই তাদের বেতন ৫০,০০০ টাকায় পৌঁছে যায়, কিন্তু এসআইপি অপরিবর্তিত থাকে।
অতিরিক্ত টাকাটা কোথায় যায়? ভালো গ্যাজেট, বেশি ভাড়া, বাইরে বেশি খাওয়া-দাওয়া, অতিরিক্ত সাবস্ক্রিপশনে। সাভারওয়াল বলেন, "আপনি খেয়াল না করলেও আপনার নেটফ্লিক্স প্ল্যান আপগ্রেড হয়ে যায়। আপনার সুইগিতে খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। কিন্তু আপনার এসআইপি অতীতেই আটকে থাকে।"
জীবনযাত্রার মানের বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের স্থবিরতার এই ব্যবধানের কারণেই সম্পদ নীরবে নষ্ট হয়ে যায়।
৪৭ লক্ষ টাকার সতর্কবার্তা
আসল ক্ষতিটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পায়। সাভারওয়াল ২০ বছরের দু'টি সাধারণ পরিস্থিতি তুলনা করেছেন, যেখানে বার্ষিক ১২ শতাংশ রিটার্ন ধরে নেওয়া হয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে, একজন বিনিয়োগকারী ২০ বছর ধরে প্রতি মাসে ৫,০০০ টাকা করে বিনিয়োগ করেন। মোট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১২ লক্ষ টাকা, এবং চূড়ান্ত তহবিল বেড়ে প্রায় ৪৬ লক্ষ টাকা হয়।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, বিনিয়োগকারী ৫০০০ টাকা দিয়েই বিনিয়োগ শুরু করেন, কিন্তু প্রতি বছর এসআইপি-র পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ করে বাড়ান। মোট বিনিয়োগ বেড়ে ৩৪ লক্ষ টাকা হয়, কিন্তু চূড়ান্ত তহবিল ৯৩ লক্ষ টাকারও বেশি হয়ে যায়।
অর্থাৎ, পার্থক্যটা ৪৭ লাখ টাকারও বেশি। সাভারওয়াল বলেন, "একই শুরু, একই রিটার্ন। শুধু একটি অভ্যাস পরিবর্তনে এই বিরাট তফাৎ গড়ে দেয়।"
কেন বেশিরভাগ এসআইপি-ই বাড়ে না
বেতন বাড়া সত্ত্বেও, বেশিরভাগ এসআইপি বিনিয়োগকারী তাদের অবদানের পরিমাণ পরিবর্তন করেন না। সাভারওয়াল এর জন্য মানসিকতাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, "একবার মানুষ ৫,০০০ টাকাকে 'বিনিয়োগের টাকা' হিসেবে চিহ্নিত করলে, তারা আর এটি নিয়ে নতুন করে ভাবেন না।"
তিনি উল্লেখ করেন, "এসআইপি আপনাকে মনে করিয়ে দেয় না যে আপনার বেতন বেড়েছে। যে ব্যক্তি আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাইট, গাড়ি এবং বাড়ি আপগ্রেড করেন, সে তাঁর এসআইপিকে দশকের পর দশক ধরে প্রাথমিক স্তরেই রেখে দেয়। যা বিরাট ভুল।"
এসআইপি-র বৃদ্ধিকে বেতনের বৃদ্ধির সঙ্গে সংযুক্ত করুন
সাভারওয়াল বলেন, "এর সমাধান সহজ এবং বাস্তবসম্মত। যদি আপনার বেতন ১৫ শতাংশ বাড়ে, তবে আপনার এসআইপি ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দিন। এই অভ্যাস মোটেই আক্রমণাত্মক নয়, বরং ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা।" তিনি ব্যাখ্যা করেন, "যদি ৩০,০০০ টাকা বেতনে ৫,০০০ টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়, তবে ৫০,০০০ টাকা আয়ের সময় এসআইপি-তে সামঞ্জস্য রেখে বিনিয়োগ করা উচিত।"
একই আয়, দু'টি ফলাফল
এমন দুই বন্ধুর কথা ভাবুন যারা একই বেতন এবং এসআইপি দিয়ে শুরু করে। দু'জনেই ৩০,০০০ টাকা আয় করে এবং মাসিক ৫,০০০ টাকা বিনিয়োগ করে। দশ বছর পর, দুজনেই ৬০,০০০ টাকা আয় করে।
একজন এসআইপি অপরিবর্তিত রাখে এবং প্রায় ১১.২ লাখ টাকার একটি তহবিল তৈরি করে। অন্যজন প্রতি বছর এসআইপি ১০ শতাংশ বাড়ায় এবং ১৬.৩ লাখ টাকা নিয়ে শেষ করে।
সাভারওয়াল বলেন, "এটি কোনও অতিরিক্ত চাপ অনুভব না করেই ৪৫ শতাংশ বড় একটি তহবিল গড়ে তোলার মরিয়া চেষ্টা। উভয়েই আয়ের একই শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। শুধুমাত্র একজন সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।"
স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাকে কঠিন কাজটি করতে দিন
আজকাল, বেশিরভাগ মিউচুয়াল ফান্ড প্ল্যাটফর্ম স্টেপ-আপ এসআইপি বিকল্প অফার করে। এগুলো প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট শতাংশে আপনার এসআইপি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়িয়ে দেয়।
সাভারওয়াল পরামর্শ দেন, "১০ শতাংশ স্টেপ-আপ সেট করুন এবং ভুলে যান। আপনার বেতনের মতোই আপনার এসআইপি নীরবে পটভূমিতে বাড়তে থাকে। আপনি পরিবর্তনটা প্রায় বুঝতেই পারেন না, কিন্তু আপনার ভবিষ্যতের সম্পদ তা ঠিকই অনুভব করে।"
বোনাসকে বুদ্ধি করে ব্যবহার করা
বোনাস হল আরেকটি হাতছাড়া হওয়া সুযোগ। বোনাসের পুরোটা খরচ না করে, সভরওয়াল পরামর্শ দেন যে, বোনাসের একটি অংশ এসআইপি-র পরিমাণ স্থায়ীভাবে বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা উচিত। তিনি বলেন, "একটি বোনাস শুধু আরাম-আয়েশের জন্য খরচ করা উচিত নয়। এটি গতি সঞ্চারের জন্য ব্যবহার করা উচিত। যখন একটি বোনাস আপনার এসআইপি বাড়ায়, তখন তা বছরের পর বছর আপনার জন্য কাজ করতে থাকে।"
যখন বিরতি দেওয়া অনিবার্য
জীবন সরলরেখায় চলে না। চাকরি হারানো, জরুরি অবস্থা এবং কর্মজীবনের বিরতি আয়ের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, সভরওয়াল বলেন যে- বিদ্যমান এসআইপি চালিয়ে যাওয়াই যথেষ্ট। তিনি জোর দিয়ে বলেন, "যদি আপনি সত্যিই বিনিয়োগ বাড়াতে না পারেন, তবে থামবেন না। এসআইপি চালু রাখাটাই হল শৃঙ্খলা। কিন্তু পরিস্থিতি উন্নত হলে, এই অভ্যাসটি আবার শুরু করুন।"
যে বেতন বৃদ্ধি আপনার নিজের প্রাপ্য
সভরওয়াল লক্ষ্য করেন, "আপনি কর্মক্ষেত্রে ১০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির জন্য তীব্রভাবে দর কষাকষি করবেন। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নিজের সম্পদে সেই বৃদ্ধির ভাগ দেবেন না।" তিনি বিশ্বাস করেন, এই বৈপরীত্যই ব্যাখ্যা করে কেন অনেক বিনিয়োগকারী তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন। তাঁর কথায়, "যদি আপনার নিয়োগকর্তা পাঁচ বছরের জন্য আপনার বেতন স্থির করে দেন, আপনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। অথচ আপনি আপনার অবসর তহবিলের সঙ্গে ঠিক সেটাই করেন।"
সহজ কথায়, একটি এসআইপি কোনও এককালীন সিদ্ধান্ত নয়। এটি একটি জীবন্ত প্রতিশ্রুতি যা আপনার জীবনের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি করতে হবে। আপনার জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ুক - কিন্তু আপনার বিনিয়োগও বাড়ুক। কারণ চক্রবৃদ্ধি সুদ শুধু ধৈর্যকেই পুরস্কৃত করে না। এটি অগ্রগতিকেও পুরস্কৃত করে।
