আমরা সাধারণত মনে করি, শেখা ও মনে রাখার ক্ষমতা একান্তই মস্তিষ্কের কাজ। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মানবদেহের সাধারণ কোষগুলিও একধরনের ‘স্মৃতি’ ধারণ করতে পারে! নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি-এর গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, মানুষের শরীরের নন-নিউরাল বা অমস্তিষ্কীয় কোষও সঠিকভাবে ব্যবধান রেখে দেওয়া সংকেতের প্রতিক্রিয়া মনে রাখতে সক্ষম।

আমরা জানি, দীর্ঘক্ষণ একটানা পড়ার চেয়ে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে পড়া বা অনুশীলন করা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। একে বলা হয় স্পেশিং এফেক্ট। এবার বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন, এই একই নীতি মস্তিষ্কের বাইরে, শরীরের সাধারণ কোষেও কার্যকর। গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কোষগুলোকে একটানা রাসায়নিক সংকেত না দিয়ে মাঝেমাঝে ছোট ছোট ‘বার্স্ট’ বা তরঙ্গ আকারে সংকেত পাঠানো হয়, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া অনেক শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।

আরও পড়ুনঃ যন্ত্রণাদায়ক মৌমাছির হুল মাত্র ৬০ মিনিটে নষ্ট করে দেয় ক্যানসারের বিষ! কী বলছে গবেষণা?

গবেষক দলটি পরীক্ষাগারে মানবদেহের কোষ তৈরি করে তাতে একটি বিশেষ টরিপোর্টার জিন’ যুক্ত করেন। এই জিনটি সক্রিয় হলে কোষের মধ্যে আলো জ্বলে ওঠে। ফলে কোষটি ‘সাড়া’ দিচ্ছে কিনা বোঝা যায়। বিজ্ঞানীরা এরপর রাসায়নিক সংকেত দিয়ে কোষে শেখার মতো পরিবেশ তৈরি করেন।

এই পরীক্ষায় অবাক করা ফলাফল মিলেছে। বিজ্ঞানীরা জানান, যখন কোষগুলো একটানা সংকেত পেয়েছিল, তখন প্রতিক্রিয়া তুলনামূলক কম ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট বিরতিতে সংকেত দেওয়া হলে সেই প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি তীব্র এবং দীর্ঘমেয়াদি হয়েছে। গবেষণায় আরও জানা যায়, এই কোষীয় শেখার প্রক্রিয়া নির্ভর করে দুটি মূল প্রোটিনের ওপর। যা ইআরকে ও সিআরইবি। এই দুই প্রোটিন মস্তিষ্কে স্মৃতি তৈরি এবং শেখার প্রক্রিয়াতেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা যখন এই প্রোটিন দুটির কাজ বন্ধ করে দেন, তখন কোষগুলোর শেখার ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়। অর্থাৎ কোষের এই আচরণ নিছক কাকতালীয় নয়, বরং এটি জীবনের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

যুগান্তকারারী গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ওষুধের চিকিৎসায় আসতে পারে বিপ্লব। গবেষকরা মনে করছেন, এই আবিষ্কার ভবিষ্যতে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বড় পরিবর্তন আনতে পারে। বর্তমানে ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে মূলত ডোজ বা পরিমাণের ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওষুধ দেওয়ার সময় ও বিরতি ঠিকঠাক নির্ধারণ করলেও তার কার্যকারিতা অনেক বেশি হতে পারে। অর্থাৎ কম মাত্রার ওষুধ দিয়েও দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যেতে পারে।

গবেষণার প্রধান বিজ্ঞানীদের কথায়, “এই গবেষণা প্রমাণ করে যে শেখা ও মনে রাখার নীতি শুধু নিউরনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জীবনের প্রতিটি স্তরেই, এমনকী একেকটি সাধারণ কোষেও এই নীতি গভীরভাবে কাজ করে।” অর্থাৎ, শেখা ও স্মৃতি শুধু মস্তিষ্কের বিশেষ গুণ নয়, এটি জীবনেরই অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। ক্লাসরুমে যেমন নিয়মিত বিরতি দিয়ে পড়া ফলপ্রসূ হয়, তেমনই শরীরের ক্ষুদ্র কোষও সময়ের ব্যবধান চিনে নিজেদের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।