
বুধবার ২১ মে ২০২৫
বুড়োশিব দাশগুপ্ত
পহেলগাঁও হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চার দিন ব্যাপী যে ‘যুদ্ধ’ চলেছে, তা নিয়ে বেশ কয়েকটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, সংঘাতের সময় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও ভারত কেন পাকিস্তানের সংঘর্ষবিরতির আর্জিতে রাজি হল? যুদ্ধপ্রিয় ‘ভক্ত’ এই সিদ্ধান্তে খুব একটা খুশি হতে পারেননি। বিদেশসচিবকে যিনি কি না একজন সাহসী মুখপাত্রও বটে তাঁকে পর্যন্ত গালিগালাজ করা শুরু করেছেন। যেন তিনিই যুদ্ধটা থামিয়ে দিয়েছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যদিও দাবি করেছেন, সংঘর্ষবিরতি করা না হলে দুই দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য থামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। ভারত-পাকিস্তানের বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ বিতর্ক সাপেক্ষ। ভারত যদিও এ হেন হস্তক্ষেপের কথা অস্বীকার করেছে।
তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সংঘর্ষবিরতি-পরবর্তী বক্তৃতায় বলেছেন যে ভারতের আক্রমণের পর পাকিস্তান পরাজয় স্বীকার করেছে এবং তারপরেই ভারতীয় প্রতিরক্ষা আধিকারিকদেরকে বারবার আলোচনার জন্য ডেকেছে। যদিও ভারতীয় মুখপাত্ররা উপগ্রহ চিত্রের সাহায্যে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছিলেন যে কীভাবে ভারতীয় আক্রমণ শুধুমাত্র জঙ্গি শিবিরগুলিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যেই করা হয়েছিল। তাঁরা সংঘর্ষের ফলে উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ দিতে একটিও শব্দ খরচ করেননি। তাঁরা বলেছেন, কেবল জঙ্গি শিবিরগুলিকে লক্ষ্য করে আঘাত হানাই তাঁদের কাজ ছিল, ‘মৃতদেহ গণনা করা নয়’ এবং স্পষ্ট করে না বলে স্বীকার করেছেন যে এই ধরনের লড়াইয়ে ‘ক্ষতি’ হয়েই থাকে।
আচমকা সংঘর্ষবিরতির দ্বিতীয় প্রধান কারণ একটি অসমর্থিত সূত্রের খবর। যেখানে বলা হয়েছিল, ভারত পাকিস্তানের পরমাণু ঘাঁটিতে হামলা করেছে। যদিও ভারতের তরফ থেকে এই দাবিকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান প্রথমদিকে এই দাবি মেনে না নিলেও, বর্তমানে এই বিষয়টি পরিস্কার (পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন) যে ভারতের মিসাইল নূর খান বায়ুসেনা ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে। যেটি কি না পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার রক্ষা করত। হামলার পরপরই ওই এলাকায় তেজস্ক্রিয়-রোধী উপকরণ বহনকারী একটি মিশরীয় বিমান দেখা যায়। যদিও পরমাণু বিষয়ক নজরদারি সংস্থা জানিয়েছে, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কোনও খবর নেই। তবে, এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, পরমাণু অস্ত্রের হুমকিই তাড়াতাড়ি সংঘর্ষবিরতি ঘোষণার অন্যতম কারণ হতে পারে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, পাকিস্তানের মতো একটি ‘জঙ্গি’ রাষ্ট্রের হাতে পরমাণু অস্ত্র তুলে দেওয়া কতটা সুরক্ষিত। প্রধানমন্ত্রী আরও এক ধাপ সুর চরিয়ে বলেন, ভারত বারবার পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি সহ্য করবে না। কারণ, এখন ভারত দেখিয়েছে যে তারা যে কোনও মুহূর্তে পাকিস্তানের পারমাণবিক ঘাঁটিতে পৌঁছতে পারে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের তীব্র আক্রমণ গোটা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিশ্লেষক এবং সংবাদদাতা স্বীকার করেছেন যে আমেরিকা বা ইউরোপ কেউই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না যে আধুনিক যুদ্ধ প্রস্তুতিতে ভারত এত দ্রুত এগিয়ে গিয়েছে। চার দিনের এই যুদ্ধ পশ্চিমি দেশগুলির জন্য প্রায় এক বিস্ময় ছিল। ঠিক যেমনটি ছিল ভারত যখন পোখরানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। পশ্চিমি দেশগুলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল যে ভারত পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। একইভাবে, ভারতীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ‘আকাশ’-এর সাফল্য সকলকে চমকে দিয়েছে। যা তুর্কি ড্রোন এবং চীনা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি পাল্টা আক্রমণ ভারতীয় মাটিতে অবতরণের আগে আকাশপথেই ধ্বংস করেছে।
প্রযুক্তি আধুনিক যুদ্ধের রূপ বদলে দিয়েছে। যুদ্ধ এখন আর ট্যাঙ্ক, সৈন্য এবং বন্দুকের মাধ্যমে হওয়া কোনও ভূপৃষ্ঠের ঘটনা নয়। এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আকাশপথে স্থান নিয়েছে এবং উপগ্রহ-ভিত্তিক হয়ে উঠেছে। ভারতের ইসরো, যা সারা বিশ্বে সম্মানিত, এখন ডিআরডিও-র সঙ্গে যুদ্ধ সরঞ্জাম পরিকল্পনা এবং নকশায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেসরকারি উদ্যোগে সরকারের প্রতিরক্ষা উৎপাদন ইউনিটগুলিকে পুনর্গঠন করা হচ্ছে। যদিও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ব্র্যান্ডের অধীনে প্রতিরক্ষা উৎপাদনে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু কার্যকর ‘যুদ্ধ’-এর মাধ্যমে প্রমাণিত যে এই উদ্যোগ সঠিক দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।