
বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫
গৌতম রায়
অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছে।সপ্তদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশনের সঙ্গে অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশনের বিস্তর ফারাক।আগের বার সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫ ক ধারা নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে অনুমোদন করিয়েছিল মোদি সরকার।লোকসভার ভিতরে ও বাইরে , বিশেষ করে জম্মু- কাশ্মীরে একদম সামরিক শাসনের ঢঙে পরিবেশ তৈরি করেছিল মোদি সরকার।
এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। বিজেপির একক গরিষ্ঠতা নেই।তাকে এন ডি এ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোটকে নিয়ে সরকার চালাতে হচ্ছে।তাই বিরোধী ' ইন্ডিয়া' জোট , সংসদের ভিতরে এবং বাইরে বিজেপিকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি নয়।স্পিকার পদ ঘিরে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে যাঁরা এই পদ সাভলেছেন, বিজেপির অটলবিহারী বাজপেয়ী পর্যন্ত একটা ঐক্যমত্যের জায়গা খোলা রেখেছিলেন।
ডেপুটি স্পিকারের পদ টি বিরোধীদের দিতেই হবে , এমন কোনো সাংবিধানিক বাধ্য বাধকতা নেই।তবে অনেকক্ষেত্রেই ডেপুটি স্পিকারের পদ টি বিরোধীদের দেওয়া টা একটা রীতি হয়ে উঠেছিল।তবে ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ বিরোধীদের ই এই পদটি দিতেন। বিধানসভা গুলিতে ও কোনো কোনো রাজ্যে এই রেওয়াজ ছিল।যদিও বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন শাসন ক্ষমতায় থাকলেও এই প্রথা কখনো অবলম্বন করে নি।এখন তৃণমূল কংগ্রেস ও করে না।
স্পিকার পদে বিরোধীরা একযোগে প্রার্থী দিলেও , কংগ্রেস এক তরফা ভাবে এই নাম ঘোষণা করেছে- তৃণমূল কংগ্রেসের প্রথমে এই অভিযোগ ছিল।যদিও বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত তৃণমূল , ইন্ডিয়া জোটের প্রার্থীকেই সমর্থন করেছে।
অনেকের যেমন আশঙ্কা এন ডি এ জোট আগামী পাঁচ বছর টিকবে নাকি, অর্থাৎ ; মোদি জোট সরকার ২০২৯ সাল পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারবেন কিনা, তেমন ই অনেকে এটাও মনে করছেন, ' ইন্ডিয়া' জোটের ও আগামী পাঁচ বছর অটুট থাকা ঘিরে।ভোটের পরে পরাজিত বি জে ডি , ইন্ডিয়া জোটের দিকে ঝুঁকেছে।উড়িষ্যাতে এখন তাদের যে রাজনৈতিক অবস্থা , তাতে জাতীয় রাজনীতিতে কিছু প্রাসঙ্গিক থাকতে, নবীন পট্টনায়কের এ ছাড়া উপায় ছিল না।
কিন্তু অষ্টাদশ লোকসভার অধিবেশনের একদম শুরুতেই স্পিকার পদে প্রার্থী ঘোষণা ঘিরে তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক অবস্থান ঘিরে অনেকেই সিঁদুরে মেঘের আশঙ্কা করছেন। বিজেপির প্রতি নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজপেয়ীর আমলে বিভিন্ন সময়ে মমতার অবস্থান ঘিরেও রাজধানীতে মৃদু আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।
বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে , বিজেপি ভোটের আগে জেতে না।ভোটের পরে জেতে।আর কিসের উপর ভরসা করে এই ' জেতা' টাকে তাঁরা ' কেনে' , তা আলাদা করে বলবার দরকার নেই।আগামী পাঁচ বছর সেই প্রক্রিয়া যে বিজেপি চালাবে না- এমনটা ভাববার কোনো কারন নেই।সে যেমন একদিকে এন ডি এ শরিকদের ঘর ভাঙাতে ব্যস্ত থাকবে, তেমনিই ঘর ভাঙাবে ' ইন্ডিয়া' র সঙ্গীদের ও।এন ডি এ সঙ্গীদের ও যেমন নীতিগত অবস্থানের প্রশ্নে কোনো দৃঢ়তা নেই , তেমনটা অবস্থা কিন্তু ইন্ডিয়া জোটের অনেকের ই।
ভি পি সিং এর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন , সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে, মুসলমান সমাজের সার্বিক নিরাপত্তার প্রশ্নে মূলায়ম সিং যাদবের যে অবস্থান ছিল , সেটি তাঁর জীবনের শেষ পর্বে , প্রয়োগের ক্ষেত্রে এক ই ধারায় চলেছিল- এটা বলা যায় না।মূলায়মের জীবনের শেষপ্রান্তে সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ঘিরে অনেক কিছুই শোনা যায়। ভুলে গেলে চলবে না, আজ যে অখিলেশ যাদবকে , যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্যে নায়কের মর্যাদা বিরোধী শিবির থেকে দেওয়া হচ্ছে, সেই অখিলেশ ই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের মেয়াদের একদম শেষ লগ্নে দিল্লি লাগোয়া মুজফফরনগরের দাঙ্গা ঘিরে কার্যত দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন।ওই দাঙ্গাই ছিল '১৪ তে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রে বিজেপির সরকার তৈরির অন্যতম চাবিকাঠি।
অখিলেশ , মমতা, তেজস্বী -- এদের সকলের মুখেই সংবিধান রক্ষার শপথ, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, মুসলমান সমাজের নিরাপত্তার দাবি-- এই সমস্ত বিষয়গুলিই ভোট রাজনীতি কেন্দ্রিক। দাদরি তে আর এস এসের হাতে নিহত শেখ আখলাখের পরিবারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গিয়েছিল কিন্তু অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ই।মমতার মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে পশ্চিমবঙ্গে ধুলাগড়, বসিরহাট, হাজিনগর ,কাঁকিনাড়া থেকে সাম্প্রতিক বেলডাঙ্গা দাঙ্গা-- একটি ক্ষেত্রে ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয় নি।
কংগ্রেস ও কিন্তু পন্ডিত নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতাতে নেই। বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে ঠেকাতে , নরম সাম্প্রদায়িকতার পথে হাঁটতে তাঁরা এখন অনেকটাই অভ্যস্থ। তবু ও একটা কথা বলতেআ হয়, এককালে পরিবারতন্ত্রের আবর্তে আকীর্ণ ডুবে থাকা এই দলটি র দীর্ঘকালের মূলকেন্দ্র বিন্দু নেহরু পরিবারের দুজন , সোনিয়া এবং রাহুল এখন সাংসদ।প্রিয়াঙ্কার সাংসদ হওয়ার সম্ভাবনা কেরালা থেকে প্রবল।তবু ও রাজনীতির কোনো পক্ষ ই এখন ওঁদের ঘিরে পরিবারতন্ত্রের কথা বলছে না।দলীয় সভাপতির পদ টি পারিবারিক বৃত্তের বাইরের মানুষ মল্লিকার্জুন খার্গে কে দিয়ে সোনিয়া অত্যন্ত রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। সোনিয়া বা রাহুল যদি এখন দলের সভাপতি থাকতেন , তাতে সাধারণ মানুষের কাছে যে বার্তা যেত, তার নিরিখে কংগ্রেসের এই ফল হওয়া সম্ভবপর ছিল না।
ছলে বলে কৌশলে ইন্ডিয়া জোটের ভিতরে তাদের পুরনো বন্ধুদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বিজেপি পুরোদমে করবে। ইন্ডিয়া জোটে বিজেপির পুরনো অনেক বন্ধুর নানা কেলেঙ্কারির বহু খবর বিজেপি জানে।সেগুলির জু জু দেখিয়ে গোপন বোঝাপড়া করে অনেক বিল পাশের ক্ষেত্রে পুরনো বন্ধুদের অদৃশ্য সাহায্য যে বিজেপি নেবে না-- এমনটাও মনে করবার কোনো কারন নেই।
পুনর্নিবাচিত অধ্যক্ষ ওম বিড়লাকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সপ্তদশ লোকসভায় বিড়লার কিছু অগণতান্ত্রিক , দলীয় পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তের কথা বিরোধী দলনেতা রাহুল বলেছেন।হাসি মুখে ওম বিড়লা তা শুনেছেন।বলা যায় শুনতে বাধ্য হয়েছেন।এই বক্তব্য যদি একক গরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসা বিজেপি সরকারের প্রার্থী ওম বিড়লার সামনে রাহুল বলতেন, পত্রপাঠ অধ্যক্ষ রাহুল গান্ধীকে লোকসভা থেকে বহিস্কৃত করতেন।
ওম বিড়লাকে রাহুলের এই খোঁচা বিনাবাক্যব্যয়ে শুনতে বাধ্য করা-- এটাই গত নির্বাচনে গোটা অবিজেপি শিবিরের জয়। খোঁটার শোধ তুলতে জরুরি অবস্থার কথা বলেছেন , অঘোষিত জরুরি অবস্থা র কলঙ্কিত নায়ক মোদি। বস্তুত বিগত বছরে মোদির অঘোষিত জরুরি অবস্থা , শ্রীমতী গান্ধীর ঘোষিত জরুরি অবস্থার যাবতীয় বিভৎসতাকে তুচ্ছ করে দিয়েছিল।আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভারতকে ধর্মান্ধ হিন্দু ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করবার প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে-- এটা সার্বিক ভাবে ইতিহাসের এক উজ্জ্বল উদ্ধার