আজকাল ওয়েবডেস্ক: নেপালে ৮ সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ হিংসার পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল—নেপালি কংগ্রেস (NC) ও ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট (UML)—যাদের শাসনামলেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তারা কয়েক দিনের জন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। দলীয় নেতারা গোপনে চলে যাওয়ায় কার্যত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাওডেল, সেনাবাহিনী ও তরুণ প্রজন্মের ‘জেন জেড’ আন্দোলনের প্রতিনিধিরা মিলিতভাবে সংসদের নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথে অগ্রসর হন।
শুরুতে আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, এককভাবে জেন জেড গোষ্ঠী এত বিশাল জনসমাগম ঘটাতে পারবে না। কিন্তু ‘হামি নেপাল’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যার নেতৃত্বে ছিলেন সুদান গুরুঙ (৩৬), দ্রুত আন্দোলনের কেন্দ্রে উঠে আসে। তরুণেরা ডিসকর্ডসহ বিভিন্ন গ্রুপ চ্যাট অ্যাপের মাধ্যমে মুহূর্তে সমাবেশ ও মিছিল সংগঠিত করতে সক্ষম হয়। প্রাক্তন রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ ও ব্যবসায়ী প্ররোচনাকারী দুর্গা প্রসাই আন্দোলনের গতিপথ নিজেদের পক্ষে নিতে চেষ্টা করলেও, তরুণ নেতারা শেষ পর্যন্ত সাংবিধানিক কাঠামো রক্ষা করে শুধু নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার পক্ষে দৃঢ় থাকেন। কাঠমান্ডুর মেয়র বाলন শাহও এই অবস্থানের পক্ষে দৃঢ় ভূমিকা রাখেন।
আলোচনা ও অনলাইন ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি (৭৩) কে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয় জেন জেড আন্দোলন। কার্কির কঠোর নীতি, অদম্য ব্যক্তিত্ব ও দুর্নীতিমুক্ত ভাবমূর্তি তাঁকে তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ‘হামি নেপাল’-এর সদস্যদের বিশেষ স্থান দেওয়া হয়। যদিও অনুষ্ঠানটি রাজনৈতিক গুরুত্বের তুলনায় এক প্রকার NGO সমাবেশের মতোই ছিল।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের দমননীতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে
রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাওডেল প্রাথমিকভাবে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চালান। ১৪ সেপ্টেম্বর এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে তিনি ঘোষণা করেন যে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে এবং ২০২৬ সালের ৫ মার্চ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
৮ সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে UML ও NC-এর ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলি ও প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের দায় এড়ানো কঠিন হবে। একইসঙ্গে, আরএসপি নেতাদের কারাগার ভাঙার ঘটনাতেও সমালোচনা তীব্র।
অন্যদিকে, জেন জেড আন্দোলনের তরুণদেরকেও ব্যাখ্যা দিতে হবে কেন তাঁদের কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর অনভিপ্রেত হিংসা ঘটে গেল এবং কিছু দুর্বৃত্ত আন্দোলনকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিল। স্কুলপড়ুয়া কিশোরদের মিছিলে আনা নিয়েও তীব্র সমালোচনা হচ্ছে।
নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আপাতত আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, হিংসার তদন্ত, এবং মার্চ ২০২৬-এ নির্ধারিত নির্বাচনের প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করবে বলে জানা গেছে। সংবিধানের মূল কাঠামো—ফেডারেল ব্যবস্থা, অন্তর্ভুক্তি ও বহুদলীয় গণতন্ত্র—অক্ষুণ্ণ থাকছে। তবে জেন জেড আন্দোলনের একাংশ সরাসরি নির্বাচিত নির্বাহী ব্যবস্থার দাবি তুলেছে, যা ভবিষ্যৎ রাজনীতির বিতর্কে রূপ নেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
নেপালের ইতিহাসে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন, গণআন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মতোই ২০২৫ সালের এই তরুণ-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন—কোনও ধরণের অরাজকতা বা ধর্মীয় মৌলবাদী হস্তক্ষেপ যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, তবে দেশ আবারও অস্থিরতার পথে হাঁটতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি আংশিক শান্ত হলেও, নেপাল এখন দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে—যেখানে তরুণদের কণ্ঠ, সেনাবাহিনীর প্রভাব ও সাংবিধানিক গণতন্ত্র রক্ষার ভারসাম্যই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের পথ।
