আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বৃহস্পতিবার সামাজিক মাধ্যমে “অসংযত প্রতিক্রিয়া ও নিয়ন্ত্রণহীনতা”-র বিপজ্জনক প্রভাব নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছে। এই মন্তব্য এসেছে সম্প্রতি সংঘটিত এক অভূতপূর্ব ঘটনার প্রেক্ষিতে—যেখানে এক আইনজীবী চিফ জাস্টিস অব ইন্ডিয়া (CJI) বিচারপতি বি.আর. গাভাইয়ের দিকে জুতো নিক্ষেপের চেষ্টা করেন।
বিচারপতি সুর্যকান্ত ও জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চের সামনে এই বিষয়টি উত্থাপন করেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা এবং সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তথা সিনিয়র আইনজীবী বিকাশ সিং। তাঁরা আদালতের কাছে অভিযুক্ত আইনজীবী রাকেশ কিশোর-এর বিরুদ্ধে অবমাননা মামলা (contempt case) দ্রুত শোনানির আবেদন জানান।
বিকাশ সিং বলেন, “ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যম সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। আদালতের মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠানিক অখণ্ডতা নিয়ে তীব্র অবমাননাকর মন্তব্য করা হচ্ছে।” তুষার মেহতা ও বিকাশ সিং উভয়েই আদালতের কাছে অনুরোধ করেন যেন আদালত সামাজিক মাধ্যমে এ ধরনের মন্তব্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটি নির্দেশ জারি করে।
বেঞ্চ জানায়, মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার “একেবারে সীমাহীন নয়”, এবং সেটি কখনোই অন্যের মর্যাদা ও অখণ্ডতার ক্ষতির বিনিময়ে প্রয়োগ করা যায় না। বিচারপতিরা বলেন, “অসংযত সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব ভয়াবহ। আমরা নিজেরাও এর উৎপাদক ও উপভোক্তা—দুয়ের ভূমিকায় আছি।” তবে আদালত এই মুহূর্তে অবমাননা মামলাটি জরুরিভাবে তালিকাভুক্ত করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। বিচারপতি সুর্যকান্ত রসিকভঙ্গিতে বলেন, “এক সপ্তাহ পরে দেখা যাক, তখনও যদি কিছু বিক্রিযোগ্য পয়েন্ট বাকি থাকে।”
ঘটনাটি ঘটে ৬ অক্টোবর, সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময়। ৭১ বছর বয়সী আইনজীবী রাকেশ কিশোর আদালতকক্ষে উপস্থিত অবস্থায় হঠাৎ করে জুতো নিক্ষেপের চেষ্টা করেন চিফ জাস্টিস গাভাইয়ের দিকে। ঘটনাটি আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর বড় প্রশ্ন তোলে। সঙ্গে সঙ্গে আদালতকক্ষের নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে আটক করে। বার কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (BCI) এরপরই তাঁর আইনজীবী হিসেবে কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়, উল্লেখ করে যে, এই আচরণ আদালতের নিয়ম ও মর্যাদার পরিপন্থী।
ঘটনার সময় চিফ জাস্টিস গাভাই ছিলেন সম্পূর্ণ সংযত। তিনি আদালতের কর্মীদের নির্দেশ দেন, “ওই ব্যক্তিকে ছেড়ে দাও, শুধু সতর্ক করে দাও। বিষয়টি উপেক্ষা করো।” পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “কিছুই আমার গায়ে বা ডেস্কে পড়েনি। কেবল শব্দ শুনেছি। হয়তো অন্য কোথাও পড়েছিল। আমি শুনেছি সে বলছে, ‘গাভাই সাহেবের দিকে ছুড়েছিলাম।’ কিন্তু আমার কোনো বিঘ্ন ঘটেনি, আমি শুনানি চালিয়ে গেছি।” পরের দিন এক শুনানিতে তিনি বলেন, “ঘটনাটি আমাদের খুবই ধাক্কা দিয়েছিল, কিন্তু এখন এটি অতীত—একটি ‘ভুলে যাওয়া অধ্যায়’। আমরা এগিয়ে গেছি।”
তবে বিচারপতি উজ্জ্বল ভূইঞা এই ঘটনায় আলাদা মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “এটি কোনো রসিকতার বিষয় নয়। এটি ভারতের প্রধান বিচারপতির প্রতি সরাসরি অবমাননা, যা পুরো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আঘাত।” তিনি আরও বলেন, “বিচারপতি হিসেবে আমরা অনেক সময় এমন সিদ্ধান্ত নিই যা সবাই সমর্থন নাও করতে পারে, কিন্তু তবুও প্রতিষ্ঠানিক মর্যাদা আমাদের অগ্রাধিকার।” সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা ঘটনাটিকে “সম্পূর্ণভাবে ক্ষমার অযোগ্য” বলে মন্তব্য করেন। তিনি একইসঙ্গে গাভাইয়ের উদার আচরণের প্রশংসা করে বলেন, “চিফ জাস্টিস যে শান্তভাবে বিষয়টি সামলেছেন, তা সত্যিই উদাহরণযোগ্য।”
উল্লেখ্য, ঘটনার সময় কিশোরকে স্বল্প সময়ের জন্য আটক করা হলেও, চিফ জাস্টিস নিজেই নির্দেশ দেন যেন কোনো মামলা দায়ের না করা হয় এবং তাঁকে সেদিনই মুক্তি দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে বিচারপতি ও আদালত সম্পর্কে নানা সমালোচনামূলক মন্তব্য ছড়িয়ে পড়ে। আদালত সে কারণেই বৃহস্পতিবার সামাজিক মাধ্যমের “অসংযত প্রভাব” নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন সাংবিধানিক অধিকার, তেমনি তা অন্যের সম্মান নষ্টের হাতিয়ার হতে পারে না। আদালত জানিয়েছে, “আইনের শাসন ও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা করা ন্যায়বিচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।” এই ঘটনায় একদিকে যেমন বিচারব্যবস্থার নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠেছে, অন্যদিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বনাম প্রতিষ্ঠানের সম্মান—এই দ্বন্দ্বও আবারও সামনে এসেছে।
