গত মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (RBI) ব্যাঙ্কিং নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে এক বৃহৎ ‘পরিষ্কার অভিযান’ চালিয়েছে। কয়েক দশক ধরে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার সার্কুলার, নির্দেশিকা ও বিজ্ঞপ্তিকে একত্র করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক মোট ২৩৮টি মাস্টার ডিরেকশন প্রকাশ করেছে। এই প্রক্রিয়ায় ১৯৪০-এর দশক থেকে জারি হওয়া প্রায় ৯,৪০০টি পুরনো নির্দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
2
10
এই মাস্টার ডিরেকশনগুলোর খসড়া প্রায় এক মাস ধরে RBI-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল, যাতে সাধারণ মানুষ ও সংশ্লিষ্ট পক্ষরা মতামত জানাতে পারেন। নির্দেশিকাগুলোর একত্রীকরণ, জনপরামর্শ গ্রহণ এবং বিপুল সংখ্যক নির্দেশ প্রত্যাহার—এই তিনটি পদক্ষেপই নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। এগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, ভারতের ব্যাঙ্কিং নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে সহজ, স্বচ্ছ ও বোধগম্য করার ব্যাপারে RBI-এর সদিচ্ছা ও আগ্রহ রয়েছে। শুধু ব্যাঙ্কগুলোর জন্য নয়, আমানতকারী, ঋণগ্রহীতা ও সাধারণ নাগরিকদের জন্যও।
3
10
তবে এই পরিষ্কার অভিযানের ব্যাপ্তি আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি করে—ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় এত বেশি ‘রেগুলেটরি কোলেস্টেরল’ কীভাবে জমে উঠল? কেন নিয়ম এত জটিল ও ভারী হয়ে উঠেছে, এবং ভবিষ্যতে কীভাবে ব্যাঙ্কের সুশাসন বজায় রেখেই এই জট খুলে ফেলা যায়?
4
10
স্বাধীনতার প্রায় পরপরই সংসদ RBI-কে ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করেছিল। ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী, দেশের ‘ব্যাঙ্কিং নীতি’ নির্ধারণ এবং ব্যাঙ্কগুলোর উদ্দেশে সাধারণ বা নির্দিষ্ট নির্দেশ জারির একচেটিয়া ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের হাতে। এই নির্দেশ ঋণ দেওয়ার খাত, জামানতের মার্জিন, সুদের হার বা ঋণের শর্ত—প্রায় সব কিছুর সঙ্গেই সম্পর্কিত হতে পারে। আরও বিস্তৃতভাবে, ‘জাতীয় স্বার্থে’, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বা কোনও ব্যাঙ্কের সঠিক পরিচালনার স্বার্থে RBI যে কোনও নির্দেশ জারি করতে পারে। এই ক্ষমতা শুধু বেসরকারি নয়, সরকারি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
5
10
গত মাসে যে ৯,৪০০টির বেশি নির্দেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেগুলো এই ‘নির্দেশ জারির ক্ষমতা’র আওতাতেই তৈরি হয়েছিল। এগুলোর কোনও একক বা মানক ফরম্যাট ছিল না—কখনও মাস্টার সার্কুলার, কখনও নোটিফিকেশন, কখনও গাইডলাইন বা প্রেস রিলিজ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও নির্দিষ্ট অভ্যন্তরীণ যাচাই বা অনুমোদন প্রক্রিয়া ছিল না; প্রতিটি বিভাগ নিজেদের মতো করে নির্দেশ জারি করত।
6
10
এই নির্দেশ রাতারাতি জারি, পরিবর্তন বা প্রত্যাহার করা যেত। কোনও নির্দেশ বিশেষ কোনও ব্যাঙ্কের জন্য, কিংবা গোটা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার জন্য প্রযোজ্য হতে পারত। আইন অনুযায়ী RBI-র সব নির্দেশ প্রকাশ করা বাধ্যতামূলকও ছিল না। ফলে কোন নির্দেশ কার্যকর এবং তালিকাটি সম্পূর্ণ কি না—তা বোঝার উপায় ছিল না।
7
10
এই বিস্তৃত স্বাধীনতার কারণেই বছরের পর বছর ধরে ব্যাঙ্কিং নিয়ন্ত্রণে নিয়মের পাহাড় জমেছে। আশ্চর্যের বিষয়, প্রত্যাহার হওয়া কিছু নির্দেশের উৎস ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছয়—যখন ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্টই ছিল না। আবার অনেক নির্দেশ ১৯৫০-৬০-এর দশকের পরিকল্পিত ঋণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, যা ৩৫ বছর আগেই বিলুপ্ত।
8
10
তবে সমস্যাটি শুধু পুরনো নির্দেশের নয়। প্রত্যাহার হওয়া নির্দেশের ৭৫ শতাংশেরও বেশি ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে জারি হয়েছিল। অর্থাৎ, উদারীকরণের পরও RBI ধারাবাহিকভাবে তার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যাঙ্কগুলোর ওপর সূক্ষ্ম হস্তক্ষেপ চালিয়ে গেছে।
9
10
আজ আমরা ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণের জটিলতাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিই। অথচ আধুনিক ব্যাঙ্কিং নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়—মূলত ২০শ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু। ১৯৩০-এর আগ পর্যন্ত ব্যাঙ্ক ছিল প্রায় ক্লাবের মতো, লাইসেন্স থাকলেও নিয়ন্ত্রণ ছিল সীমিত। ১৯৩০-এর মার্কিন আর্থিক সংকট, সঞ্চয়ের আর্থিকীকরণ এবং ১৯৮০-এর দশকের পর বিশ্বায়নের ফলে বাসেল চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ জটিল হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়ায় সহজ ও বোধগম্য নিয়ম তৈরির মূল নীতিটি উপেক্ষিত হয়।
10
10
ভারতেও তাই হয়েছে। RBI-এর সাম্প্রতিক উদ্যোগ সত্ত্বেও, ঋণদাতা সংস্থাগুলোর ওপর প্রযোজ্য নির্দেশিকাগুলো মিলিয়ে এখনো প্রায় ১৩,০০০ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে—যা ভবিষ্যতে আরও সরলীকরণের প্রয়োজনীয়তাই তুলে ধরে।