“আর কি কখনও কবে/এমনও সন্ধ্যা হবে ” — রবীন্দ্রগানের কথাই বারবার মনে ধাক্কা দিতে থাকে, ইন্দ্রাশিস আচার্যর নতুন ছবি ‘গুডবাই মাউন্টেন’ দেখতে গিয়ে। অপূর্ণ প্রেম মানেই ভারতীয় চলচ্চিত্রে এমনই এক রক্তাক্ত বিচ্ছেদ, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে লায়লা-মজনু বা রোমিও-জুলিয়েটের অন্তহীন প্রেম-সম্ভাবনা ও তারপর হাতে হাত রেখে মৃত্যুবরণে। নিঃসন্দেহে তেমন প্রেমের আখ্যান শাশ্বত। কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলির মাথুর পর্যায়ের বিরহ, ‘এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর’-এর অনন্ত দুঃখগাথাকে চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়াসটা খুব সহজ নয়। ‘এক দুজে কে লিয়ে’ থেকে বাংলা ভাষায় ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ হয়ে ‘আশিকি ২’ বা হালের ‘সাইয়ারা’— প্রেমে মিলন হওয়া না-হওয়ার যে কাব্য জনমানসে প্রায় ‘এপিক’ হয়ে ধরা দিয়েছে বারবার, তাতে এমন অসহনীয় নীরবতা সবসময় লেগে থাকে না, যেমনটা ধরে রেখেছেন ইন্দ্রাশিস আচার্য, তাঁর সাম্প্রতিক ছবিটিতে। 


ইন্দ্রাশিস আচার্যর চলচ্চিত্রভুবনে জটিল মানব-মনস্তত্ত্বের নানা রঙের কড়ি জমানো। ‘বিলু রাক্ষস’, ‘পিউপা’-র অন্ধকারাচ্ছন্নতা যেমন সেখানে আছে, ‘পার্সেল’-এ থ্রিলার ও সূক্ষ্ম ডার্ক কমেডির মিশেল যেভাবে ঘটাতে পারেন ইন্দ্রাশিস, আবার ‘নীহারিকা’-র শ্বাসরোধকারী স্লথতাও তাঁর চিত্রভাবনার পরিসরে উপস্থিত। ‘নীহারিকা’ ইন্দ্রাশিসের শেষ ছবি ‘গুডবাই মাউন্টেন’-এর আগে। এই দুই ছবির মধ্যে দূরত্ব কম। এই দু’টি ছবিই ‘সম্পর্ক’ নামক একটি নিরালম্ব বায়ুভূত ধারণাকে তার প্যাঁচালো অথচ রক্তমাংসের শরীরে দেখে। ‘নীহারিকা’ মূল চরিত্রকে ছবির প্রায় মাঝামাঝি সরিয়ে নিয়ে যায় এক আশ্চর্য জনশূন্যতায়, তারপর রুক্ষ প্রকৃতির মধ্যিখানে মানুষ চরিত্রদের আলোআঁধারিকে বারবার ছিন্নভিন্ন করা হয়। ‘গুডবাই মাউন্টেন’ প্রথম থেকেই জনমুখর বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত করে দেয় দর্শককে। অর্জুন (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) ও আনন্দী (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) এই দুই চরিত্রের সংলাপ ও নীরবতার মধ্যেই অনেকক্ষণ চলাফেরা করতে হয় দর্শককে। এর মাঝে শুধু চিকিৎসক অর্পিতার (অনন্যা সেনগুপ্ত) বারবার আসা আভাস দেয় এই আখ্যানের মূল সূত্রর। অসুখ এই দ্বিমুখী আদানপ্রদানের মধ্যে যে আরেকটি না-দেখা চরিত্র, তা স্পষ্ট না করেও অর্পিতা বারবার ফিরে আসে, নিরাময়ের আলো সে দেখাতে পারে না, শুধু মনে করিয়ে দেওয়া, জরা কোথাও এই দুই চরিত্রের সংলাপের মাঝে দাঁড়িয়ে। কোনও না কোনওদিন শেষ হবে এই সংলাপ।


অর্জুন এবং আনন্দী পুরনো প্রেমিক-প্রেমিকা। যে ভুল বোঝাবুঝির দরুন তারা এত দূরে, তার সামান্য ইঙ্গিত একটি সংলাপে ধরা থাকে ছবির শেষের দিকে। কিন্তু সত্যিই অতীত এখানে কোনও ভার বহন করে না। কবিতায়-গানে অর্জুন-আনন্দীর কথাবার্তা কখনও খুবই কৃত্রিম হয়ে ওঠে, এতটাই যে, যা ঘটছে, তার বাস্তবতাকে সন্দেহের মুখে দাঁড় করায় তা দর্শকের সামনে। ওই জড়তা, খানিক অস্বাভাবিকত্বর হোঁচট খেয়ে চলাই ছবির ছন্দ তৈরি করে একভাবে। এর মাঝে যে তরুণ-তরুণীর দল এসে হাজির হয়, তারা অর্জুন-আনন্দীদের পুরনো বন্ধুদলকে কোথাও কি মনে করিয়ে দেয়? বয়সের ভুলভ্রান্তিকে পেরিয়ে আসা এই যুগলের সামনে যখন কাঁচা ভুলের হঠাৎ ঘনিষ্ঠতা, ঈর্ষা ও শত্রুতার সামান্য দাঁতনখটুকু জোরালো হয়ে যায়, তখন বোঝা যায়, পরিণত মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বের সামনে এই ঘটনাক্রমটুকু নেহাতই এসে হাজির হচ্ছে না।


তাই আনন্দীর স্নানের জলের ফেনা অর্জুনের হাতে তুলে নেওয়া, তাদের ঘন হওয়ার মুহূর্ত, অর্পিতার প্রতি আনন্দীর অনুচ্চারিত সন্দেহ, আনন্দীর স্বামী রথীজিতের (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) অন্দরের হত্যাকারী মন ও ধর্ষকামের পাশাপাশি স্ত্রীয়ের অন্য সম্পর্কের আভাসের কথা ভেবে বারবার কেঁদে ফেলা, সরাসরি অভিযোগ তুলতে না পারার দীর্ঘশ্বাসের ময়নাতদন্তে ওই হঠাৎ এসে হঠাৎ চলে যাওয়া তরুণদের দলটির রেখে যাওয়া ছায়া-অভিঘাতটুকু টের পাওয়া যায়।
‘নীহারিকা’-র রুক্ষ প্রকৃতি এখানে কিন্তু কেরলের ওয়ানাডের অপূর্ব, নয়নাভিরাম সবুজ। কিন্তু অমন প্রাণখোলা নিসর্গেও কোনও প্রেমের পরিপূর্ণতা না থাকা, হঠাৎ গোধূলিবেলায় ওই তরুণদের একজনের একা চলে যাওয়া পাহাড়ি পথ ধরে, রথীজিতের সন্দেহ, অধিকারবোধ ও হিংস্র কল্পনা, মৃত্যুমুখী অর্জুনের নিখুঁত মহত্ত্বের মাঝে কিছুটা থমকে থাকা আনন্দীকে এভাবে ডেকে পাঠানোর ভেতরের চাহিদার টানাপোড়েন, অর্পিতার জীবনমৃত্যুর মাঝে থাকা একটি মানুষের দিকে নিরলস, অপারগ তাকিয়ে থাকার চিহ্নগুলো লেগে থাকে। শান্তনু দে-র চিত্রগ্রহণ, লুব্ধক চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনা সেই চিহ্নগুলো প্রকট যেমন করে না, তেমনই কিছুটা তার সূত্র ধরিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না। 


রণজয় ভট্টাচার্যর সংগীতে গানের চেয়েও আবহ তীব্র হয়ে থাকে। আর অভিনয় এই ছবিকে আলাদা করে জ্যোতিষ্মান করার চেষ্টা করে না। ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত তাঁদের চরিত্রের সঙ্গে নির্জন হয়ে ওঠেন, আর তাঁদের সোচ্চার অথচ নিচু তারের অভিনয়ে সঙ্গত করে চলেন অনন্যা সেনগুপ্ত। অনির্বাণ ভট্টাচার্য এই ছবিতে দর্শকদের সামনে আসেন অনেকটা পরে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নিজের চরিত্রকে পৌঁছে দেন তার আলোছায়াসমেত, দর্শকমনে। জয়শ্রী অধিকারী-সহ বাকি তরুণরা স্বচ্ছন্দ, কিন্তু কোথাও তাদের চরিত্রগুলি আরেকটু সাবলীলতাও দাবি করেছিল। তবে, এই ছবির সংলাপের আরেকটু সংযম প্রয়োজন ছিল। সংলাপ কোথাও অতিরেক, কোথাও একটু বেশিই নতশির। সংলাপই কোথাও কোথাও সকলেরই অভিনয়ের খানিক ছন্দপতনও ঘটিয়েছে।
লর্ড ব্রাউনিংয়ের ‘দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার’ বিচ্ছেদের যে শান্ত কবিতালেখ, এই ছবির আত্মায় তার ছাপ স্পষ্ট। ইন্দ্রাশিস আচার্যর এখনও ইস্তক সেরা কাজ একে হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু চলচ্চিত্রভাষা নিয়ে তাঁর আত্মমগ্নতা এই ছবিতেও ধরা থাকল।