আজকাল ওয়েবডেস্ক: এক সপ্তাহেরও বেশি সময় আগে লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী এক সংবাদ সম্মেলনে সারা দেশে ভোটার তালিকা ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিলেন। গণতন্ত্রের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিতে পারে এমন এই অভিযোগের পরপরই স্বচ্ছ ও দ্রুত তদন্ত শুরু করার পরিবর্তে, ভারতের নির্বাচন কমিশন  বেছে নিয়েছে এক ভিন্ন কৌশল। কমিশন রাহুলকে শপথপত্রে অভিযোগ জমা দিতে বলেছে—অর্থাৎ তদন্ত শুরু করার আগে দায়িত্ব উল্টে অভিযোগকারীর কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে।

এদিকে মূলধারার গণমাধ্যমের মনোযোগ ধীরে ধীরে সরে গেছে এই অভিযোগ থেকে। টেলিভিশন ও সংবাদমাধ্যমের প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে একের পর এক চটকদার সংবাদ—সাবেক উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়া নিয়ে গুজব, ভারতীয় বিমানবাহিনীর ‘অপারেশন সিন্দুরে’ ছয়টি পাকিস্তানি বিমান গুলি করে নামানোর দাবি, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাকি মাল্টায় বসবাস শুরু করেছেন—এমন খবর (যা পরে খারিজ হয়েছে), এবং সর্বশেষ ‘আবেগঘন’ বিতর্ক—আবর্জনার মতো ছড়িয়ে পড়া পথকুকুর নিয়ে দেশজোড়া আলোচনা।

আধুনিক সেন্সরশিপ: ব্লক নয়, বিভ্রান্তি

এই প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন—আজকের দিনে সেন্সরশিপ মানে তথ্য আটকে দেওয়া নয়, বরং তথ্য প্রবাহকে এভাবে ভাসিয়ে দেওয়া যাতে মূল সমস্যার প্রতি জনসাধারণের মনোযোগ ভেঙে যায়। আমেরিকান সাংবাদিক মার্ক মাসনিক যেটিকে বলেছেন ‘স্ট্রেইস্যান্ড এফেক্ট’—অর্থাৎ তথ্য আটকে দিতে গেলে উল্টে তা আরও বেশি আলোচনায় আসে। তাই সরকার বা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সরাসরি ব্লক না করে নানা চটকদার বা আবেগঘন বিতর্ক তৈরি করে মূল ইস্যুকে ঢাকা দেয়।

সমাজতত্ত্ববিদ জেইনেপ তুফেকচি দেখিয়েছেন—২০১১ সালে মিশরে হোসনি মুবারকের ব্যর্থ সেন্সরশিপ নীতি থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বের বহু রাষ্ট্র এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জনআন্দোলনকে দমাতে সূক্ষ্ম কৌশল ব্যবহার করে। এর লক্ষ্য হলো নাগরিকদের মধ্যে হতাশা, নিরুৎসাহ আর অসহায়ত্বের বোধ তৈরি করা, যাতে মানুষ প্রতিবাদ করার মানসিক শক্তিই হারিয়ে ফেলে।

ভারতে এই মুহূর্তে একই কৌশল দেখা যাচ্ছে। একদিকে রাহুল গান্ধীর ব্যক্তিগত বিশ্বাসযোগ্যতাকে আক্রমণ করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু গত এক দশকের ধারাবাহিক প্রচারণায় তার ভাবমূর্তি বহুবার ক্ষুণ্ণ হওয়ায়, নতুন আক্রমণের প্রভাব সীমিত। অন্যদিকে মনোযোগ সরাতে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘পথকুকুর’ ইস্যুর মতো আবেগঘন ও তর্কপ্রবণ বিষয়, যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা টকশোতে টেনে নেওয়া যায় এবং সরকারের সরাসরি ভূমিকা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ হয় না।

ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতা কেন জরুরি

গণতন্ত্র নিয়ে ভারতীয় অভিজাত মহলে প্রায়ই সংশয় দেখা যায়। কিন্তু ইতিহাস বলছে—ভারতীয় রাষ্ট্রের বৈধতা মূলত টিকে আছে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ওপর।

অঞ্চল: সুদীপ্ত কবিরাজের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ভারতবর্ষে সবসময়ই একদিকে ছিল সাম্রাজ্য গড়ার প্রবণতা, আর অন্যদিকে ছিল আঞ্চলিক টানাপোড়েন। স্বাধীনোত্তর ভারতে রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্ক টিকে আছে মূলত প্রতিনিধিত্বের প্রতিশ্রুতির কারণে। ভোট প্রক্রিয়া দুর্বল হলে এই ভারসাম্য ভেঙে যেতে পারে।

জাতপাত: সর্বজনীন ভোটাধিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্ণদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়েছে, যা প্রথাগত হিন্দু সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে চ্যালেঞ্জ করে। ভোট প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হলে এই শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনার জায়গা হারিয়ে যাবে, এবং জাতপাতের সংঘাত সহিংস আকার নিতে পারে।

শ্রেণি: অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়লেও ভোটাধিকারই নিশ্চিত করেছে যে খাদ্যশস্যের ভর্তুকি থেকে শুরু করে মৌলিক কল্যাণনীতি কোনো সরকার পুরোপুরি বাতিল করতে সাহস পায় না।

ধর্ম: হিন্দুত্ববাদী চাপের মাঝেও নাগরিকরা ভোটের মাধ্যমেই একাধিকবার শাসক দলকে কঠিন বার্তা দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে—ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা রক্ষার শেষ অস্ত্র এখনও ব্যালটবাক্স।

সংকেত স্পষ্ট

রাহুল গান্ধীর অভিযোগকে উপেক্ষা করা শুধু একটি রাজনৈতিক দলের বিজয় বা পরাজয়ের প্রশ্ন নয়। এটি জাতীয় সত্ত্বার অস্তিত্বের প্রশ্ন। ভোট যদি বিশ্বাস হারায়, তবে ভারতীয় রাষ্ট্রকে ধরে রাখা সামাজিক চুক্তিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।

নাগরিকের দায়িত্ব

আজকের সেন্সরশিপে কেবল রাষ্ট্র নয়, আমরা নিজেরাও অংশীদার। টেলিভিশন বিতর্ক ও ভুয়া উত্তেজনায় ডুবে গিয়ে আমরা নিজেরাই মূল ইস্যু ভুলে যাই। কিন্তু নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব আমাদের—গণতন্ত্রের ভিত্তি ভেঙে পড়ছে কি না, সেটির দিকে বারবার মনোযোগ ফিরিয়ে আনা। ভোট প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্গঠন সম্ভব কেবল নিরপেক্ষ ও কঠোর তদন্তের মাধ্যমে। বিভ্রান্তি নয়, জবাবদিহিই হতে হবে গণতন্ত্র রক্ষার একমাত্র পথ।