গোপাল সাহা
 
“বাবু চোখটা আমার চলে গেল, ডান চোখে দেখতে পাই না। কোনও রকমে জুতো সেলাইয়ের কাজ করি, নিজের ও পরিবারের পেট চালাই এই ভাবেই।”

‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়’ সেই স্বাধীনতা হীনতাতেই জীবনের চাকা ঘোরা শুরু। সুদূর বিহার থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জুতো সেলাইয়ের কাজ শুরু করেছিলেন জুতো সেলাই শিল্পী (মুচি) মানো দাস। সাল আনুমানিক ১৯২০। তারপর থেকে জুতো সেলাই করে জীবনযাপন। আর্থিক অনটনের কারণে অন্নসংস্থানের উদ্দেশ্যে সুদূর বিহারে পরিবারকে ছেড়ে কলকাতা এসে শুরু হয়েছিল জীবনের পথ চলা। মুচি ‘মানো’র জীবনের পথ চলা শুরু হয়েছিল মাত্র ১৫-১৬ বছর বয়সে, অন্নসংস্থান হতো জুতো সেলাই করেই। তারপর কেটে গেছে বহু যুগ, গত হয়েছেন মানো। কিন্তু থেমে যায়নি কাজ। সেই জুতো সেলাইয়ের পরম্পরা আজও বজায় রেখেছেন তাঁর ছেলে রূপলাল দাস। ডালহৌসির এক বহুতলের নীচে বসে আজও সেই জুতো সেলাই করে কর্মসংস্থান ৭১ বছরের রূপলাল।

ব্রিটিশ শাসনের সময়কালে বর্বরোচিত বহু ঘটনার সাক্ষী ছিলেন মানো। তাঁর ছেলে রুপলাল জানিয়েছেন, ব্রিটিশ আমলে বহু ইংরেজ অফিসাররা তাঁর বাবার কাছে আসতেন জুতো সেলাইয়ের জন্য। ইংরেজ অফিসাররা মানোকে নিয়ে যেতেন তাঁদের ডালহৌসি চত্বরে তৎকালীন ব্রিটিশ অফিসে। এক আনা বা দু’আনার খুব সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময় করে দিতেন জুতো সেলাই। 

মানো সেই সময়ে জুতো সেলাই করে কোনও রকমে সংসার চালিয়ে নিলেও নিজের পেট ভরানো দায় হয়ে উঠতো। কিন্তু, নিজের দেশপ্রেমকে কোনভাবে চাপা দিতে পারেননি। একাধিকবার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সহযোগিতা করতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়তে হয়েছিল মানোকে। দৃঢ় চিত্তে বহু বিপদকে উপেক্ষা করে পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের তাগিদে নানা কৌশলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর স্বাধীনতার সূর্য উদয়ের সেই উন্মাদনা এবং ভারতমাতার স্বাধীন হওয়ার আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কথা জানিয়েছেন রূপলাল। 

রুপলালের কথায়, তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ শাসনের বর্বরোচিত অত্যাচারের ঘটনা তাঁর বাবার চোখে বহুবার পড়েছে যার কারণে তিনি নিজেকে ঠিক রাখতে পারতেন না। ক্রোধ ও ক্লেশে ফেটে পড়তেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছলেবলে কৌশলে সহযোগিতা করলেও নিজের পরিবার ও সন্তান-সন্ততির কথা ভেবে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারেননি। যার কারণে বহু আক্ষেপও প্রকাশ করেছেন মানো। সামান্য জুতো সেলাই কারিগর, ফুটপাতে বসে জুতো সেলাই করছে এমনটা ভেবে হয়তো ইংরেজরা তাঁকে সন্দেহ করবে না। সেই সুযোগ নিয়েও বহুবার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মানো। অবশেষে তিনি ২০০০ সালে বার্ধক্যের কারণে কর্মবিরতি নেন। বার্ধক্যজনিত কারণে বেশ কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন মানো। তাঁর ছেলে জুতো সেলাই করে একইভাবে জীবনধারণ করছেন সেই একই জাগায় বসে।

১৯৬৬ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে অভাবের তাড়নায় বাবার হাত ধরে বিহার থেকে জুতো সেলাইয়ের কাজ শিখতে কলকাতায় এসেছিলেন রূপলাল। বিহারের জমুইয়ের বাসিন্দা। পরিবারে তাঁর বর্তমানে স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে, তিনি চাষাবাদের কাজ করে। রূপলালের পথ অনুসরণ করেননি পরিবারের কেউই। 

আজকাল ডট ইন-এর মুখোমুখি হয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে রূপলাল বলেন, “বাবু চোখটা আমার চলে গেল, ডান চোখে দেখতে পাই না। বছর পাঁচেক আগে অপারেশন হয়, তারপর বহু চিকিৎসার পরেও দৃষ্টি ফেরেনি। কোনও রকমে জুতো সেলাইয়ে কাজ করি, বাম চোখ দিয়ে আবছা কোনও রকম দেখে। অনেক চেষ্টা করেও ডান চোখটা ফেরাতে পারলাম না। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ডান চোখটা একেবারেই দৃষ্টিহীন, শুধু এখন বাম চোখ দিয়ে কোনও রকম দেখি। বাম চোখটা অপারেশন করে ভগবানের দয়ায় ঠিক হয়ে গেছে তাই দেখতে পাই তবে চশমা পরতে হয়। এখনও কষ্ট করে বাবুদের জুতো সেলাই করেই পেট চলে, আর কিছু টাকা দেশে পাঠাই।”