গোপাল সাহা 

ধীরে ধীরে সমাজ ব্যবস্থা ও মানুষের ধৈর্য যেন কোথায় হারিয়ে যেতে বসেছে। অল্পেতেই মানুষ হয়ে উঠছে মারমুখী, মানুষ মানুষের প্রতি যেমন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তেমনই ভাল-মন্দ বিচার না করেই হিংসার বশবর্তী হয়ে মানুষ আইনকে হাতে তুলে নিচ্ছেন, একই রকম ভাবে মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে গণপিটুনি বা গণপ্রহারের পথ বেছে নিচ্ছেন। যা একেবারেই আইনবিরুদ্ধ ও নৃশংসতা বা নির্মমতার পরিচয়। মানুষ গণপিটুনি বা গণপ্রহারের পথ বেছে নিচ্ছেন কি তবে হিংসার বশবর্তী হয়ে না কি মানুষ হারিয়ে ফেলছেন ধৈর্য?

গণপিটুনি অনেকটা ছোঁয়াচে রোগে পরিণত হয়েছে সমাজে। কখনও চোর সন্দেহে, কখনও নিজেরাই অপরাধী বা দোষী সাব্যস্ত করে আইন হাতে তুলে নিয়ে গণপিটুনির পথ বেছে নিচ্ছে জনগণ। ‘মব সাইকোলজি’তে মানুষ তার নিজস্বতা হারায় যাকে বলে ‘ডি-ইনডিভিজুয়েশন’।  আপাতভাবে যে মানুষটি কোনA সাতপাঁচে থাকতেন না, সেই মানুষটি হঠাৎ বীর পরাক্রমশালী হয়ে ওঠেন। অনেকটা ‘ডমিনো এফেক্ট’-এর মতো। ক্রোধ, ষড়রিপুর দ্বিতীয় রিপু। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে রামায়ন সব কিছুই হয়েছে ক্রোধ ও অপমান সহ্য করতে না পেরে। গণপিটুনিতে যে মানুষটি সক্রিয় ভূমিকা প্রহণ করেন, তার মধ্যে কোনও মানসিক সমস্যা আছে কি না তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তাৎক্ষণিক আবেগের বশবর্তী হয়ে যেমন মানুষ তাদের দীর্ঘদিন থেকে জমে থাকা রাগ, অভিযোগ, অভিমান সব কিছু চরিতার্থ করে হাতের সুখ মিটিয়ে নেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে কেন ঘটে এ ধরনের গণপিটুনির মত অপরাধ?

সিগময়েড ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের ‘ইড’ (Id) বা আদিম প্রবৃত্তি আমাদের সব রকম বিধিনিষেধ ও সামাজিকভাবে আরোপিত শর্ত তুলে নিতে চায়। কিন্তু ‘সুপারইগো’ বা বিবেক চায় সঠিক পথ প্রদর্শন করে আমাদের নীতিগত ও আইনপ্রণিত পথে নিয়ে চলতে। কিন্তু ছাপোষা মধ্যবিত্ত হরিপদ কেরানিও প্রবলপরাক্রমী বীরপুঙ্গব হয়ে ওঠেন এই ‘গণপিটুনি’র অংশীদারত্বের ভাগীদার হতে।

আরও পড়ুন: আরও চওড়া দরজা, আরও বেশি সুবিধা! যাত্রী সুবিধার্থে মেট্রোর নতুন রেক এল কলকাতায়

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রঞ্জন ভট্টাচার্য এই বিষয়ে বলেন, “যখন ভয়, রাগ, উৎকণ্ঠা একত্রিত হয়ে ওঠে এবং অন্য সাথীরাও যখন যোগদান করছেন, তখন তারা নির্ভীক ও অসীম সাহসী হয়ে পরেন এই ভেবে যে, যুগপৎভাবে করা এই বেআইনি কাজ হয়তো আইনি বৈধতা পাবে এবং একার উপরে কোনও দায় বর্তাবে না, যাকে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বলে। আর যার কারণে এক বিরাট সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ ঘটিয়ে বসে একটা মব বা জনগোষ্ঠী।”

কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

১. মমবয়েসেঁ র তত্ত্ব অনুযায়ী, চাররকম ‘ক্রাইড’ হয়- 'ক্যাজুয়াল, কনভেনশনাল, এক্সপ্রেসিভ ও অ্যাগ্রেসিভ।
 
২. বার্লোনগি-র মতে, সম্নিলিত জনগণ তিন প্রকারের হয়, স্পেক্টেটর বা দর্শক, ডেমনস্ট্রেটর বা প্রতিক্রিয়াশীল এবং এসকেপিং বা পলাতক।

৩. ফরাসি বুদ্ধিজীবি তথা দার্শনিক গুস্তাভ লি বন- এর মতে ‘জনরোষ’, সে মন্ত্রী হোক বা আমলা, চোর সন্দেহে অপরাধী বা নিরপরাধী যার উপরেই আসুক না কেন, তিনটি ধাপে আসে। 

  • প্রথম ধাপটিকে বলা হয় ‘সাবমার্জড’ স্টেট যখন সাবমেরিনের মতো ধিকিধিকে ক্রোধ পুঞ্জীভূত হয় কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ হয় না। 
  • দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আসে এক্সপ্রেসিভ ফেজ যখন রাগের ব্যাপ্তি দাবানলের মতো ছড়াতে থাকে।
  • তৃতীয় ধাপ আসে এক্সপ্লোসিভ ফেজ যখন ক্রোধোন্মত্ত জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ‘মব লিঞ্চিং’ এর মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে।

জনতা জনার্দনকে মনে রাখতে হবে এটি একটি দন্ডনীয় অপরাধ এবং ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’ ২০২৩-এর ১০৩ (২) ধারা অনুযায়ী যখন পাঁচজনের বেশি সংগঠিত হয়ে ‘মব লিঞ্চিং’-এর ঘটনা ঘটায় তখন তা হত্যা বা খুন হিসেবে গণ্য করা যায়। এর শাস্তি ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও জরিমানা অবধি হতে পারে।

তাই প্রয়োজন ধৈর্য, মননশীলতা, বিচক্ষণতা ও আইনরক্ষকদের সদর্থক ভূমিকা পালন করা। অপরাধীর দ্রুত সাজা ও সমস্ত প্রভাব ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে আইন ও বিচারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক হতাশা, উদ্বেগকে দূর করা প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া। তাহলে জনরোষে জনবলি হওয়া থেকে সরে এসে অপরাধীর/নিরপরাধীর বিচার আইনমাফিক করা প্রয়োজন। পুলিশ-প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি ভরসা থাকুক। আমাদের মনের অন্দরে লুকিয়ে থাকা হিংস্র পশুটিকে সরিয়ে প্রকৃত দ্বায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠি।