আজকাল ওয়েবডেস্ক: দশকের পর দশক ধরে মৌপালকেরা লড়াই করে চলেছেন এক ক্ষুদ্র পরজীবী ভ্যারোয়া ডেস্ট্রাক্টর-এর বিরুদ্ধে যা পৃথিবীজুড়ে মৌমাছির উপনিবেশ ধ্বংস করেছে। কিন্তু এখন আরও ভয়ঙ্কর এক মাইট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে  নাম ট্রোপিল্যাপস মার্সিডিসি, সংক্ষেপে "ট্রোপি"। মৌপালকেরা আশঙ্কা করছেন, এটি ভ্যারোয়ার থেকেও মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিশ্বের কয়েকশো কোটি মানুষ, যারা মৌমাছি-পরাগায়িত উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল।


ট্রোপির স্বাভাবিক আশ্রয়দাতা হল দৈত্যাকার মৌমাছি, যা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে সাধারণ। একসময় এ মাইট পশ্চিমা মৌমাছি-তে সংক্রমিত হয়  যা পৃথিবীর প্রায় সবখানেই মৌপালকেরা পালন করেন। এই প্রজাতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়ায় ট্রোপি ক্রমশ পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
ইতিমধ্যেই ইউক্রেন, জর্জিয়া ও দক্ষিণ রাশিয়ায় এর উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে, আর ইরান ও তুরস্কেও থাকার সন্দেহ করা হচ্ছে। সেখান থেকে এটি দ্রুত পূর্ব ইউরোপে ঢুকে পড়বে এবং পরবর্তীতে পুরো মহাদেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা। অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।


ভ্যারোয়ার মতো ট্রোপিও মৌমাছির ডিম বন্ধ হওয়া কোষে প্রজনন করে। মৌমাছির শূককীট থেকে পূর্ণবয়স্ক হওয়ার সময় যে মোমে ঢাকা কোষে থাকে, সেখানেই এই মাইট বংশবিস্তার করে। এটি মৌমাছির শূককীট খেয়ে ফেলে এবং মারাত্মক ভাইরাস ছড়ায়, যেমন ‘ডিফর্মড উইং ভাইরাস’— যা সবচেয়ে প্রাণঘাতী মৌ ভাইরাস। তবে ভ্যারোয়ার সঙ্গে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে।

আরও পড়ুন: বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে আগুন, বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা


ভ্যারোয়া পূর্ণবয়স্ক মৌমাছির গায়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু ট্রোপি পারে না। ডিমবদ্ধ কোষের বাইরে এটি মাত্র কয়েকদিন টিকে থাকে, দ্রুত নতুন শূককীট খুঁজতে মধুচক্র জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। ফলে এটি কোষের ভেতরে বেশি সময় কাটায় এবং দ্রুত বংশবিস্তার করে। যেখানে একটি ভ্যারোয়া সংক্রমিত কোষ থেকে এক-দুইটি বংশধর বেরোয়, সেখানে ট্রোপি অনেক বেশি সংখ্যায় এবং দ্রুত প্রজনন করে, পুরো উপনিবেশকে দ্রুত ভেঙে ফেলে।


এশিয়ার কিছু অঞ্চলে যেখানে ট্রোপি ইতিমধ্যেই ছড়িয়েছে, ছোট ও মাঝারি আকারের মৌপালকেরা রানী মৌমাছিকে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ খাঁচাবন্দি করে রাখেন। রানী নতুন ডিম দিতে না পারায় কোনও নতুন শূককীট জন্মায় না, ফলে মাইটের খাদ্য উৎস বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই পদ্ধতি কার্যকর হলেও হাজার হাজার মৌচাক পরিচালনাকারী ইউরোপীয় বাণিজ্যিক পালকদের জন্য তা অবাস্তব।


অন্য সমাধান হল ফর্মিক অ্যাসিড প্রয়োগ, যা কোষের মোম ভেদ করে মাইটকে মেরে ফেলে কিন্তু কম ঘনত্বে ব্যবহার করলে শূককীটকে ক্ষতি করে না। এটি কার্যকর একটি হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু ভ্যারোয়া নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত অধিকাংশ রাসায়নিক ট্রোপির বিরুদ্ধে কার্যকর নয়।


ভ্যারোয়া অনেকটা সময় পূর্ণবয়স্ক মৌমাছির শরীরে কাটায়, যেখানে মাইটনাশক ওষুধ সহজেই তার শরীরে লাগে। কিন্তু ট্রোপি সচরাচর প্রাপ্তবয়স্ক মৌমাছির গায়ে ওঠে না, বরং চাকের গায়ে ছুটে বেড়ায়। ফলে রাসায়নিকের প্রভাব এড়িয়ে যায়। এর ফলে ভ্যারোয়া দমনের প্রচলিত ওষুধ ট্রোপির বিরুদ্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অকেজো।


একসঙ্গে ভ্যারোয়া ও ট্রোপি নিয়ন্ত্রণ করা আরও জটিল। বিভিন্ন ওষুধ মিশিয়ে ব্যবহার করলে মৌপালন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং মধুতে বিষক্রিয়া ছড়াতে পারে। যেমন ট্রোপির জন্য ফর্মিক অ্যাসিড ও ভ্যারোয়ার জন্য আমিত্রাজ একসাথে দিলে মৌমাছিও মারা যেতে পারে। তাছাড়া অতিরিক্ত ওষুধ ব্যবহার করলে প্রতিরোধী জাত তৈরি হবে, যেমনটা ভ্যারোয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে।


এই নতুন পরজীবী শুধু মৌপালনই নয়, কৃষিকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মৌমাছি বহু ফসলের গুরুত্বপূর্ণ পরাগায়ক। মৌমাছির উপনিবেশ দ্রুত নষ্ট হলে মধু উৎপাদন ব্যয়বহুল হবে এবং পরাগায়ন সেবার খরচ বাড়বে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে খাদ্যের দাম ও প্রাপ্যতার ওপর। থাইল্যান্ড ও চীনের মতো দেশে কার্যকর ব্যবস্থাপনার উপায় খুঁজতে গবেষণা চলছে। কিন্তু যদি দ্রুত বাস্তবসম্মত সমাধান বের না হয়, তবে এই মাইট বিশ্বজুড়ে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলবে। ভ্যারোয়ার কাহিনি দেখিয়েছে কীভাবে একটি মাত্র পরজীবী বিশ্বব্যাপী মৌপালন পাল্টে দিতে পারে। ট্রোপির ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি— এটি দ্রুত ছড়ায়, দ্রুত উপনিবেশ ধ্বংস করে এবং নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন।