আজকাল ওয়েবডেস্ক: “যদি নিজের ঘর পরিষ্কার না থাকে, পিঁপড়েরা দরজা দিয়ে ঢুকবে, আর তার টানেই আসবে সাপ”—নেপালের বর্তমান সংকট যেন সেই প্রবাদটির বাস্তব রূপ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি ও দমনমূলক পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিক্ষোভ কয়েক দিনের মধ্যেই তীব্র রূপ নিয়েছে।

৪ সেপ্টেম্বর নেপাল সরকার মার্কিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলিকে নিষিদ্ধ করে। এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে বিপুল সংখ্যক তরুণ। পুলিশ গুলি চালালে ১৯ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। এরপর পরিস্থিতি দ্রুত অস্থির হয়ে ওঠে। কয়েক দিনের মধ্যে বিক্ষোভকারীরা রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি, সংসদ ভবন ও রাষ্ট্রপতি ভবনে আক্রমণ চালায়। এই তীব্র অস্থিরতার জেরে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র-ডানপন্থী সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে।


নেপালের এই অস্থিরতার ব্যাখ্যায় দুটি প্রধান তত্ত্ব ঘুরপাক খাচ্ছে—

ব্যবস্থাগত ব্যর্থতা: দীর্ঘকালীন দুর্নীতি, অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ও সুবিধাবাদী জোট রাজনীতির কারণে সমগ্র রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি জনমানসে আস্থা ভেঙে পড়েছে।


 কালার রেভলিউশন তত্ত্ব: যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি (NED)-এর আর্থিক সাহায্যে ২০১৫ সালে গড়ে ওঠা সংগঠন হামি নেপাল-এর মাধ্যমে বিদেশি শক্তি বিশেষত আমেরিকা এই আন্দোলন পরিচালনা করছে।

এই দুই ব্যাখ্যা আংশিক সত্য হলেও প্রকৃত সমস্যার মূলে থাকা কাঠামোগত বৈপরীত্যকে আড়াল করছে। নেপালের একশ বছরের পৃষ্ঠপোষক অর্থনীতি, জমি ও আর্থিক পুঁজির ওপর অভিজাত শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ, এবং ঋণনির্ভর উন্নয়ন কৌশলকে এই তত্ত্বগুলি গুরুত্ব দিয়ে  দেখে না।

 

১. সুযোগের অপচয়
২০১৫ সালের সংবিধান প্রণয়নের পর জনগণের মধ্যে প্রবল আশা জন্মেছিল যে বামপন্থী শক্তি সমাজের রূপান্তর ঘটাবে। ২০১৭ সালের নির্বাচনে বামপন্থীরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পরবর্তী সময়ে দলগুলির মধ্যে বিভাজন ও অভিন্ন কর্মসূচির অভাবের কারণে সুযোগ নষ্ট হয়। ২০২১ সালে ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের পর থেকে বামপন্থী দলগুলির ক্ষমতার রদবদল জনমানসে ভোগবাদ ও ব্যক্তিস্বার্থের প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।

২. মৌলিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা
২০১৫ সালের ভূমিকম্পে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়। দারিদ্র্য, জাতিগত বৈষম্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দুরবস্থা—এসব সমস্যার যথাযথ সমাধান হয়নি। যদিও দারিদ্র্য কিছুটা কমেছে, বিদ্যুতের প্রবেশাধিকারে উন্নতি হয়েছে—তবুও বৈষম্য ও বেকারত্বের জ্বালা প্রশমিত হয়নি।

৩. হিন্দু রাজতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রবণতা
ভারতের উত্তরপ্রদেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব নেপালের মধ্যবিত্ত ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ওপর পড়েছে। তারা হিন্দু রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে সরব হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি (আরপিপি), শিবসেনা নেপাল, বিশ্ব হিন্দু মহাসভা প্রভৃতি শক্তি এই প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে। ভারতের আরএসএস-এর আন্তর্জাতিক শাখা হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘ (এইচএসএস) নেপালে দীর্ঘদিন ধরে সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে।

৪. অভিবাসনের ক্লান্তি
নেপাল বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শ্রম অভিবাসী দেশ। বর্তমানে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ নেপালি বিদেশে কর্মরত। কোরিয়ায় সম্প্রতি তরুণ শ্রমিক তুলসি পুন মাগরের আত্মহত্যা অভিবাসী সংকটের প্রতীক হয়ে উঠেছে। গত পাঁচ বছরে কোরিয়াতেই ৮৫ জন নেপালি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম মনে করে, সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের তুলনায় অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি অনেক কম যত্নবান।

৫. বহিরাগত প্রভাব—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত
ওলি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ ছিল। ২০১৭ সালে নেপাল মার্কিন এমসিসি (Millennium Challenge Corporation)-তে যোগ দেয়, যা দেশীয় বামপন্থীদের বিরোধিতার মুখে পড়ে। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রকল্প পুনরায় চালুর চেষ্টা করছে। অপরদিকে, ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকার নেপালে হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থী শক্তিগুলিকে উৎসাহ জুগিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবারের আন্দোলনে আমেরিকার তুলনায় ভারতের প্রভাবই বেশি ছিল।

অস্থির পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে আপাত শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এই শান্তি অনিশ্চয়তার পর্দা মাত্র। আলোচনায় এসেছে কাঠমান্ডুর জনপ্রিয় মেয়র বালেন্দ্র শাহ কিংবা প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কির নাম—তাঁদের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী করা হতে পারে। তবে তাঁদের হাতে কোনো প্রকৃত রাজনৈতিক ম্যান্ডেট থাকবে না, ফলে গণতন্ত্র নিয়ে মানুষের হতাশা আরও গভীর হতে পারে। নেপালের বর্তমান সংকট কেবল একটি সরকারের পতন নয়, বরং দীর্ঘকালীন কাঠামোগত সংকটের বহিঃপ্রকাশ। দুর্নীতি, বৈষম্য, বেকারত্ব ও রাজনীতির সমাধান ছাড়া ভবিষ্যতের পথ সুগম হবে না। আপাতত ধুলো থিতো হওয়ার অপেক্ষা, কিন্তু তার আড়ালে লুকিয়ে আছে গভীর অস্থিরতার আভাস।