আজকাল ওয়েবডেস্ক: বাংলাদেশে রেকর্ড বৃষ্টিপাতে সাপের কামড়ে  আতঙ্ক ছড়িয়েছে। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিম্নভূমি, বিশেষত পদ্মা নদীর তীরবর্তী জলাভূমিগুলিতে সাপের উপদ্রব এখন এক অপ্রতিরোধ্য বিপদে পরিণত হয়েছে। ঘন বৃষ্টি, বন্যা ও আবাসস্থল নষ্ট হওয়ার ফলে সাপ এখন গ্রামাঞ্চলে ঢুকে পড়ছে, ফলে গ্রামবাসীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন এবং হাসপাতালগুলো সাপের দংশনে আক্রান্ত রোগীতে ভরে উঠছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এ বছর বাংলাদেশে প্রায় ১৫,০০০ জন সাপের কামড়ের রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং ইতিমধ্যেই ৮৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে।

রাজশাহীর নিমতলা গ্রামের কৃষক আনন্দ মণ্ডল চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেন, ধানক্ষেতে কাজ করার সময় হঠাৎ পায়ে সাপ কামড় দেয়। “আমি কথা বলতে পারছিলাম না, নড়তেও পারছিলাম না,” বলেন তিনি। “বমি হচ্ছিল, শরীর শিথিল হয়ে যাচ্ছিল, মুখ দিয়ে লালা পড়ছিল।” ৩৫ বছর বয়সী এই কৃষককে তিনদিন আইসিইউতে থাকতে হয়েছিল। এখনো তিনি নিদ্রাহীন রাত আর পেশির ব্যথায় ভুগছেন এবং আর চাষের জমিতে ফেরেননি। তাঁর স্ত্রী সুনীতা রানি, যিনি নিজে একজন স্থানীয় হেকিম, বলেন, “চিকিৎসার খরচ বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”

উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে এমন গল্প এখন প্রতিদিনের ঘটনা। এক গৃহবধূ রেজিনা বেগম বলেন, “কখনো কখনো সাপ বিছানার কাছেও চলে আসে।” নদীর ধারে কাপড় কাচার সময় তিনি জানান, বন্যার পরে ঘরে ঘরে সাপের ভয়। স্থানীয় বাসিন্দা মহম্মদ বাবলু বলেন, “ক্ষেতে হাঁটার সময় বুক কাঁপে, শুধু গতকালই সাতটা সাপ মারা হয়েছে।”

চিকিৎসকদের মতে, এবারের অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার জল সাপদের প্রাকৃতিক আশ্রয় থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক আবু শাহীন মহম্মদ মাহবুবুর রহমান জানান, জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ওই হাসপাতালে অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে সাপের কামড়ে। গত নয় মাসে তারা এক হাজারেরও বেশি রোগী চিকিৎসা করেছেন, যার মধ্যে ২০৬টি ক্ষেত্রে বিষধর সাপ—কোবরা, ক্রেইট এবং মারাত্মক রাসেল ভাইপার—এর কামড় ছিল। “অনেক রোগীরই কিডনি বিকল হয়ে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।

আরও পড়ুন: অতমারি সম্ভাবনা প্রবল, ৪০ হাজার বছর পুরনো এমন ভয়ঙ্কর ভাইরাসকে জাগিয়ে তুললেন বিজ্ঞানীরা, কিন্তু কেন?

দেশজুড়ে এই বছর ৮৪টি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, যা গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম হলেও পরিস্থিতি এখনো বিপজ্জনক। ২০২৪ সালে ১১৮ জন মারা গিয়েছিলেন, যা সাম্প্রতিক বছরগুলির মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ সংখ্যা। রাসেল ভাইপারের সংখ্যা ২০১৩ সালের পর থেকে আবার দ্রুত বেড়ে উঠেছে। এই প্রজাতির সাপ ডিম না পেড়ে একসঙ্গে ৬০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়, ফলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন, “এরা চমৎকার সাঁতারু এবং জল hyacinth-এর ওপর ভেসে দূরদূরান্তে চলে যেতে পারে।” এবারের প্রবল বর্ষণ তাদের বিস্তারে আরও সহায়তা করেছে।

রাজশাহী অঞ্চলে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১,৪০৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি নগরায়ণ ও কৃষিকাজের ধরণ বদলে যাওয়াও এই সমস্যাকে তীব্র করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহর নাইম ওয়ারা বলেন, “তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তাই তারা এখন মানুষের কাছাকাছি বসবাস করছে।”

স্বাস্থ্য মন্ত্রকের  বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমান জানিয়েছেন, সরকার অ্যান্টিভেনমের মজুত বাড়াচ্ছে। “পরবর্তী তিন সপ্তাহের জন্য পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম আছে, আরও চালান পথে রয়েছে,” বলেন তিনি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি অ্যান্টিভেনম সবসময় কার্যকর হয় না, কারণ বিভিন্ন অঞ্চলের সাপের বিষের গঠন ভিন্ন। দেশীয় অ্যান্টিভেনম তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, বিশেষত রাসেল ভাইপারের জন্য, যদিও সেটি কার্যকর হতে এখনও অন্তত তিন বছর লাগবে।

গ্রামবাসীরা এখন নিজেরাই নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিচ্ছেন—রাতে লাঠি ও টর্চ নিয়ে চলা, ক্ষেতে কাজের সময় জিন্স ও বুট পরা, এবং মশারি টানিয়ে ঘুমানো এখন তাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মহম্মদ বাবলু বলেন, “কখন কার সঙ্গে কী হবে কেউ জানে না, আমরা প্রতিদিন সেই ভয় নিয়ে বেঁচে আছি।”