আজকাল ওয়েবডেস্ক: “আমরা ভেবেছিলাম আল্লাহ দয়া করেছেন,” বললেন হাজেরা খাতুন (৬০)। “পুলিশ বলল, এতদিন ধরে যে বিদেশি মামলা নিয়ে আমরা লড়ছি, আজই তার শেষ হবে। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সেটা ছিল এক মিথ্যা ফাঁদ।” ২৫ মে, হাজেরা খাতুন ও শোনা ভানু (৫৮) – আসামের বরপেটা জেলার দুই মুসলিম বৃদ্ধা – সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ (SP)-এর কার্যালয়ে ডেকে পাঠানোর খবর পেয়ে আশাবাদ নিয়ে বের হন বাড়ি থেকে। তাঁদের বলা হয়েছিল, বহু বছরের পুরনো ‘বিদেশি’ তকমা মুছে ফেলা হবে। দুই মহিলাই দীর্ঘ সময় ধরে ফরেনার্স ট্রাইবুনালের (FT) রায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন।

কিন্তু সেই আশার আলো খুব শীঘ্রই অন্ধকারে পরিণত হয়। পুলিশের দপ্তরে পৌঁছনোর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়, জল বা খাবার কিছুই দেওয়া হয়নি। এরপর তাঁদের গোপনে একটি গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়ালপাড়া জেলার মাতিয়া ট্রানজিট ক্যাম্পে – ভারতের সবচেয়ে বড় বন্দি শিবির, যেটি তথাকথিত 'অবৈধ বিদেশি'দের জন্য বরাদ্দ।

জঙ্গলের পথে, অস্ত্রের মুখে সীমান্ত পেরোনো

২৭ মে ভোররাতে তাঁদের ১৪ জনের একটি দলের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। হাজেরা ও শোনার বর্ণনায়, বিএসএফ জওয়ানরা অস্ত্র তাক করে জঙ্গলঘেরা পথ ধরে তাঁদের ঠেলে নিয়ে যায় সীমান্তের দিকে। “আমরা প্রাণভয়ে বাধ্য হয়েছিলাম,” বলেন শোনা ভানু। “আমরা জানতাম না আমাদের মারবে, না কোথায় নিয়ে যাবে।” ২৮ মে সকালে তাঁরা পৌঁছন ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ, যা তাঁরা মনে করছেন বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার কোনো এক প্রান্ত। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, মাথার ওপর রোদ, না ছিল বসার জায়গা, না ওষুধ, না খাবার। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (BGB) পরে তাঁদের খুঁজে পায় এবং অস্থায়ীভাবে একটি খোলা মাঠে আটকে রাখে। সন্ধ্যার দিকে তাঁদের একটি অস্থায়ী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে দেওয়া হয়েছিল একটিমাত্র সাদামাটা খাবার। “সারা শরীর ভিজে গেছিল, মশায় কেটেছিল, মনে হচ্ছিল আমরা আর বাঁচব না,” বলেন শোনা ভানু।

D-ভোটার থেকে FT-র রায়: দীর্ঘ ও দুঃসহ যাত্রা

হাজেরা ও শোনার যন্ত্রণার সূচনা হয়েছিল সেই ২০১০-এর কাছাকাছি সময়ে, যখন তাঁদের নাম ভোটার তালিকায় সন্দেহভাজন ভোটার বা D-voter হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই D-voter ক্যাটেগরি চালু হয় ১৯৯৭ সালে, যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন কাউকে সন্দেহজনক নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপর তাঁদের নাম পাঠানো হয় ফরেনার্স ট্রাইবুনালে (FT), যেগুলি আসাম সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়। এই ট্রাইবুনালগুলিতে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের অভাব দীর্ঘদিন ধরেই মানবাধিকার সংস্থাগুলির অভিযোগের বিষয়। বহু নিরীহ, দরিদ্র ও নিরক্ষর মুসলিম পরিবারকে শুধুমাত্র বানান বা জন্ম সার্টিফিকেটের অভাবে ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২৩ সালের শেষে পর্যন্ত এই ট্রাইবুনালগুলি ১.৫ লক্ষেরও বেশি মানুষকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করেছে, যার বেশিরভাগই মুসলিম নারী, যাঁদের প্রায়শই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে পিতৃপরিচয় প্রমাণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।


আরও পড়ুন: তবলিঘি জামাত: ‘করোনা জেহাদ’ থেকে আদালতের অব্যাহতি — ধর্মীয় উন্মত্ততার কালো অধ্যায় ফের প্রশ্নের মুখে 

হাজেরা খাতুন বলেন, “আমার কাছে সব ডকুমেন্ট ছিল — জমির দলিল, ভোটার লিস্ট, বিয়ের কাবিননামা। তবু আমাকে বিদেশি বলল। আমি এই মাটিতে জন্মেছি, আমার বাবা-ঠাকুর্দাও এই দেশেই জন্মেছিলেন।” শোনা ভানু বলেন, “আমি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারি না, কিন্তু ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারি।” তাঁরা আগে কয়েক বছর করে আটক ছিলেন ফরেনার্স ডিটেনশন ক্যাম্পে। পরে গৌহাটি হাইকোর্টে আবেদন করে জামিন পান। জামিনের শর্ত ছিল প্রতি সপ্তাহে থানায় হাজিরা দেওয়া। হাজেরার মেয়ে জানান, “আমার মা এক সপ্তাহও বাদ দেননি। অসুস্থ হলেও, ঝড়-জল হোক, তিনি থানায় গেছেন।”

আইনভঙ্গ করে ‘পুশব্যাক’

আসাম সরকার ২০২৫ সালের মে মাসে ‘অবৈধ বিদেশি’দের বিরুদ্ধে হঠাৎ করে এক অভিযান চালায়। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বিধানসভায় ঘোষণা করেন, ৩০০-রও বেশি মানুষকে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করা হয়েছে ১৯৫০ সালের The Immigrants (Expulsion from Assam) Act-এর আওতায়। কিন্তু আইনজীবীরা বলছেন, এইভাবে কাউকে দেশছাড়া করা সম্পূর্ণ বেআইনি। ভারতীয় সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কেবলমাত্র প্রামাণ্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং প্রমাণসাপেক্ষেই কাউকে বিতাড়ন বা ডিপোর্ট করা যায়। “এগুলো কোনো ডিপোর্টেশন নয়, বেআইনি পুশব্যাক। যার ফলে মানুষজন কার্যত রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ছেন,” বলেন ধুবরির এক মানবাধিকার আইনজীবী।

নিখোঁজ করিম আলি

২৫ মে, একইভাবে নিখোঁজ হন বরপেটার জানিয়া গ্রামের করিম আলি (৭০)। তাঁর ছেলেকে ফোন করে জানানো হয়েছিল, SP অফিসে ডেকে পাঠানো হচ্ছে বিদেশি মামলা নিষ্পত্তির জন্য। কিন্তু SP অফিসে পৌঁছনোর পর ছেলেকে বের করে দিয়ে করিম আলিকে আটকে ফেলা হয়। পরে পুলিশি গাড়িতে করে তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়, তা জানে না কেউ। করিম আলি আগে পাঁচ বছর ধরে গোয়ালপাড়ার বন্দিশিবিরে আটক ছিলেন। করোনা মহামারির সময় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মুক্তি পান। তারপর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী বলেন, “ওখানে পচা খাবার খাইয়ে শরীরটা একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে।” তাঁর পরিবারের ধারণা, তিনিও বেআইনি ভাবে বাংলাদেশ সীমান্তে পুশব্যাক হয়ে গেছেন। একটি মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায় তাঁর পরিবার গৌহাটি হাইকোর্টে মামলা করেছে।

আতঙ্ক ও অবিশ্বাসের ছায়া

হাজেরা খাতুন বর্তমানে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শোনা ভানু বলেন, “আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। আবার যদি পুলিশ আসে, আমি হয়তো হার্ট অ্যাটাকে মারা যাব।” এই ঘটনা আসামে বর্তমান সরকারের অধীনে এক নতুন ধরণের জাতিগত শুদ্ধিকরণের আভাস দিচ্ছে — যেখানে আইনি প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে মুসলিম নাগরিকদের ধীরে ধীরে রাজ্যছাড়া করা হচ্ছে। এই যে বেআইনি পুশব্যাক নীতি, তা এখন মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের প্রতীক হয়ে উঠছে আসামে। প্রশ্ন উঠছে — এর শেষ কোথায়? আর কতজন সাধারণ, নিরীহ মানুষ এই অবিচারের শিকার হবেন?