বিভাস ভট্টাচার্য

 

লোকসভার বিরোধী দলনেতা। লোকসভা থেকে বিধানসভা, দেশের প্রতিটি নির্বাচনেই তাঁকে দেখা গিয়েছে দলের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। দেশজুড়ে কংগ্রেসের অতীত 'গৌরব' ফিরিয়ে আনতে তিনি করেছেন 'ভারত জোড়ো যাত্রা'।

তিনি রাহুল গান্ধী। যার কাঁধে ভর করে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা। বিহারের এই বিধানসভা নির্বাচনেও তাঁকে দেখা গিয়েছে ভোটের অনেক আগে থেকেই সেখানে ঘাঁটি গেড়ে রাজনৈতিক লড়াই করতে।

কিন্তু শুক্রবার যতই বেলা গড়িয়েছে ততই চওড়া হয়েছে নীতিশ কুমার এবং বিজেপির হাসি। ম্রিয়মাণ হতে শুরু করেছেন কংগ্রেস প্রার্থী ও নেতৃত্ব। 

এই নির্বাচনের আরেকটি বড় বিশেষত্ব হল দেশে ভোটার তালিকা সংশোধন বা এসআইআর চালু হওয়ার পর বিহারই হল প্রথম রাজ্য যেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। বিহারের এই এসআইআর পদ্ধতি নিয়ে একের পর এক অভিযোগ উঠে এসেছে।

লক্ষ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ গিয়েছে। যা নিয়ে বলতে গিয়ে বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন বিজেপির রাজনৈতিক ফায়দার জন্য এই এসআইআর করছে নির্বাচন কমিশন।

কিন্তু সবকিছু মিলিয়েও বিরোধী দলগুলি বা আলাদা করে কংগ্রেস এই ভোটের দিকে তাকিয়ে ছিল। কারণ এসআইআর করার পর যদি বিজেপিকে ধাক্কা দেওয়া যায় তাহলে দেশের অন্যান্য রাজ্যের নির্বাচনেও টাটকা অক্সিজেন যোগাত বিরোধী দলগুলিকে এবং অবশ্যই কংগ্রেসকে। 

বিহারে প্রচারে গিয়ে একেবারেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন রাহুল গান্ধী। ক্ষেতে কৃষক বা নদীতে মাছ ধরা অবস্থায় জেলেদের সঙ্গে আলাপচারিতা বা স্থানীয়দের সঙ্গে সাঁতারে অংশ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে যা ফুটে উঠেছে।

বারবার চেষ্টা করেছেন একথা প্রমাণ করতে "আমি তোমাদেরই লোক"। ভিড় হয়েছে তাঁকে দেখতে এবং ভিড় হয়েছে তাঁর কথা শুনতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত শিকে ছেঁড়েনি। শোচনীয় পরাজয় হয়েছে কংগ্রেসের।

যা নিয়ে বলতে গিয়ে প্রাক্তন সাংসদ এবং রাজ্য কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, "রাহুল গান্ধীকে ঘিরে যে জনস্রোত লক্ষ্য করা গিয়েছিল সেই স্রোতকে টেনে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল ভোট বাক্স পর্যন্ত। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি বিহারে কংগ্রেস সাংগঠনিকভাবে এতটাই দুর্বল যে তারা সেটা করে উঠতে পারেনি। আবার এটাও সত্যি যেভাবে ভোটারদের টাকা দেওয়ার বিষয়টি শেষমুহূর্তে উঠে এল সেখানে কংগ্রেস কর্মীদের কিইবা করার থাকতে পারে! বা এখানে রাহুল গান্ধীই বা কী করতে পারেন?" এটা কি রাহুলের ইমেজে একটা ধাক্কা? প্রদীপ জানিয়েছেন, তিনি আদৌ মনে করেন না এটা রাহুলের ইমেজে কোনও ধাক্কা। 

দেশে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে আইএনডিআইএ জোট। সেখানে সামিল হয়েছে বিভিন্ন দল। জোটের নানা বৈঠকে রাহুলকে দেখা গিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে।

সদ্য হয়ে যাওয়া বিহার নির্বাচন এই প্রশ্নও কিন্তু তুলে ধরেছে বিজেপি বিরোধী এই জোটেও কি রাহুলের 'ইমেজ' আগের মতো বহাল রইল? বা এককথায় রাহুলের সেই আগের ইমেজ রইল কি রইল না?

রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি রাহুল সিনহার কথায়, "রাহুল গান্ধী জোর করে নেতা হয়েছেন। নিজেদের ক্ষমতা এবং পয়সার জোরে জোর করে নেতা হয়েছেন। জনগণ এমন শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে যে আর নেতা হওয়ার শখ থাকবে না। সারা দেশ জুড়েই ব্যাপকভাবে ধাক্কা খেল। কংগ্রেসের হাল এমনিতেই খারাপ তার উপর রাহুল জোর করে আলাদাভাবে নিজের যে একটা ইমেজ গড়ার চেষ্টা করেছিল সেটাও ধাক্কা খেল। যেটা তাঁর রাজনৈতিক জীবনেও একটা বড় আঘাত।" 

ভোটের ফলাফল কি রাজনৈতিক নেতাদের ইমেজ তৈরির কারিগর? অতীতেও দেখা গিয়েছে যে নেতা বা নেত্রীকে সামনে রেখে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে লড়েছে তারা হেরে গিয়েও ফের পরবর্তী নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে এসেছে।

সেই নেতা বা নেত্রীকে সামনে রেখেই জিতে আসার এরকম উদাহরণ কিন্তু কম নেই। এবিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায়-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "আমি প্রথমেই বলতে চাই এটা আমার দলের মতামত নয়। একজন দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার ধারণা।"

তাঁর কথায়, "এই নির্বাচনে একদিকে যেমন বিজেপিকে সাহায্য করেছে এসআইআর তেমনি তারা ব্যবহার করেছে রাজ্যের সরকারি টাকা। যা তারা নির্বাচনের আগে রাজ্যের মহিলাদের অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেদের পক্ষে ভোট টেনে এনেছে। এর পাশাপাশি একটা খুব বড় বিষয় হল নির্বাচনের আগেও কিন্তু বিহারে কংগ্রেস ভালো জায়গায় ছিল না। ওই রাজ্যে কংগ্রেস আরজেডি'র থেকেও অনেক দুর্বল। গোটা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে হয় কংগ্রেস মুছে গিয়েছে অথবা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে গিয়েছে। সেখানে রাহুল বিহারে তাঁর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। নির্বাচন কিন্তু একটা বহমান প্রক্রিয়া। নির্বাচন একজন রাজনৈতিক নেতার ইমেজ তৈরি করে বা বিসর্জন দেয় সেটা আমি বিশ্বাস করি না। ইন্দিরা গান্ধীও নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। তাঁকে নিয়েও সেইসময় সিপিএম কম ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করতে ছাড়েনি‌। কিন্তু তিনবছরের মধ্যেই তিনি আবার জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।" 

ইমেজের থেকেও বড় কথা হল দেশের নির্বাচন ঘিরেই উঠতে শুরু করেছে প্রশ্ন। মনে করেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী‌।

তাঁর কথায়, "গোটা বিশ্বে ভারতের নির্বাচন নিয়ে আগে কোনো প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু এখন প্রশ্ন বাড়ছে। বাস্তবে মানুষের মন আর ভোটের ফলাফলে ফারাকটা যদি বেড়ে যায় তাহলে শুধু ফল দেখেই কোনো মন্তব্য করাটা অর্থহীন। দেশ এখন এমনভাবে চলছে বা চালানো হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি ছাড়া আর কারুর ইমেজ থাকবে না! এটাই তো এখনকার সময়ের বৈশিষ্ট্য। ফলে কারুর যখন ইমেজ থাকবে না বা ধাক্কা খাবে তখন রাহুল গান্ধীরও ধাক্কা খাবে। খানিকটা নরেন্দ্র মোদি না হলে অমিত শাহ গোছের একটা মনোভাবের মধ্যেই দেশকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।"