আজকাল ওয়েবডেস্ক: কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মাসিক পরিদর্শনে জুন মাসে মোট ১৮৫টি ওষুধের ব্যাচকে “নন-স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটি” (NSQ) অর্থাৎ মানহীন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুক্রবার (১৮ জুলাই) এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ওষুধ মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (CDSCO)। ভারতের আইনি মানদণ্ড অনুযায়ী যেসব ওষুধ নির্ধারিত মান পূরণ করে না, সেগুলিকেই NSQ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জুন মাসে CDSCO নিজে ৫৫টি ওষুধ ব্যাচের ত্রুটি শনাক্ত করে, আর বাকি ১৩০টি ব্যাচ রাজ্যস্তরের ওষুধ নিয়ন্ত্রকদের দ্বারা ধরা পড়ে। এই তালিকা কোনো এককালীন নয়। গত এক বছর ধরে প্রতি মাসেই CDSCO এইরকম মান পরীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। সংস্থাটির বক্তব্য, ‘‘বাজারে বিক্রয় ও বিতরণের পর্যায় থেকে ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে বিশ্লেষণ করা হয় এবং যেগুলি মানহীন প্রমাণিত হয়, তাদের তালিকা প্রকাশ করা হয় যাতে সংশ্লিষ্ট মহল সতর্ক হতে পারে।’’ এই মাসের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যেসব ওষুধে বেশি ত্রুটি ধরা পড়েছে, সেগুলির মধ্যে রয়েছে নানা রকমের অ্যান্টিবায়োটিক, ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট, এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ—উভয়ই মুখে খাওয়ার ও ইনজেকশন ফর্মে।

আরও পড়ুন: AI ব্যবহার করে বাড়ছে যৌন স্ক্যাম, শিশুদের লক্ষ্য করে বাড়ছে ডিজিটাল ব্ল্যাকমেল

গুরুতর ত্রুটি ও তাদের ঝুঁকি

সবচেয়ে বিপজ্জনক NSQ ত্রুটিগুলির মধ্যে রয়েছে জীবাণুমুক্ততার অভাব (Improper sterility)। এই ত্রুটির ফলে ওষুধে ক্ষতিকর জীবাণু থেকে যেতে পারে, যা রোগীর শরীরে গুরুতর সংক্রমণ, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। পার্টিকুলেট ম্যাটার বা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রবেশ করা ক্ষুদ্র কণা বহু ইনজেকশনে ধরা পড়েছে। ডিসক্রিপশন ত্রুটি অর্থাৎ ওষুধের গায়ে লেখা বর্ণনার সঙ্গে বাস্তব গঠন মেলেনি। যেমন সাদা রঙের ট্যাবলেট কমলা রঙের পাওয়া গেছে। লোস অন ড্রাইং মানে ওষুধের আর্দ্রতার অভাব, যা সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ায়। অ্যাসে ত্রুটি অর্থাৎ ওষুধে উল্লেখিত উপাদানের চেয়ে বেশি বা কম পরিমাণে উপস্থিত থাকা। বেশি হলে ওভারডোজ, আর কম থাকলে আন্ডারডোজ হয়ে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটাতে পারে।

কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কারা দোষী?

পাকসন্স ফার্মাসিউটিক্যালস প্রাইভেট লিমিটেড-এর ৬টি ইনজেকশন NSQ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যার মধ্যে আছে ডেক্সামেথাসোন, অ্যাসকরবিক অ্যাসিড (ভিটামিন C), অ্যাড্রেনালিন, ওন্ডানসেট্রন, ও জেন্টামাইসিন ইনজেকশন। Phaex Polymers-এর কলেস্টাইরামিন ও সোডিয়াম পলিস্টাইরিন সালফোনেট ইনজেকশনে আর্দ্রতার অভাব ধরা পড়েছে। Zee Laboratories-এর ট্রানেক্সামিক অ্যাসিড ইনজেকশনে অ্যাসে ত্রুটি ছিল, এবং গ্লিপিজাইড-মেটফরমিন ট্যাবলেটে রঙের গরমিল ছিল। Martin & Brown BioSciences-এর ক্যালসিয়াম গ্লুকোনেট ইনজেকশন ও র‍্যাবেপ্রাজল ইনজেকশনে কণা, বর্ণনা ও ভলিউম সমস্যা ছিল। Healers Lab-এর টেলমিসারটান ট্যাবলেটে দ্রবীভবনের ত্রুটি ধরা পড়েছে।

রাজ্য পর্যায়ে কী ধরা পড়ল?

Puniska Injectables-এর সোডিয়াম ক্লোরাইড ইনজেকশনের ৫টি ব্যাচে জীবাণুমুক্ততার অভাব ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব উৎপাদিত ডেক্সট্রোজ ও সোডিয়াম ক্লোরাইড ইনজেকশন-এও একই জীবাণুমুক্ততার সমস্যা পাওয়া গেছে। Martin & Brown-এর ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন D3 ট্যাবলেটের ১৩টি ব্যাচে রঙের সমস্যা ধরা পড়েছে। Vivek Pharmachem-এর প্যারাসিটামল ও সিপ্রোফ্লক্সাসিন ট্যাবলেটের মধ্যে বর্ণ ও দ্রবীভবনের ত্রুটি ছিল। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ত্রুটি দেখা গেছে Safe Care Life Sciences-এর মেকোবালামিন ইনজেকশনে। এতে ২,৫০০ mg/ml থাকার কথা থাকলেও মাত্র ২.৩৮ mg/ml পাওয়া গেছে। Oscar Remedies-এর সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও ডেক্সামেথাসোন কান/চোখের ড্রপে সিপ্রোফ্লক্সাসিনের পরিমাণ ৯৪৩.৩৩% বেশি পাওয়া গেছে!

এই রিপোর্ট ভারতের ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার এক গভীর সংকটকে তুলে ধরেছে। শুধুমাত্র ওষুধ সংস্থা নয়, সরকারি পর্যায়ে তদারকি ও গুণমান নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি পরিষ্কার। রোগীর জীবন নিয়ে এমন উদাসীনতা দ্রুত বন্ধ করতে হবে—নয়তো তা পরিণত হবে জনস্বাস্থ্যের এক ভয়ানক বিপর্যয়ে।