তিনি শুধু গায়ক ছিলেন না—ছিলেন এক জীবন্ত আবেগ, এক বহুমুখী প্রতিভা, এক অবিশ্বাস্য শিল্পী। তিনি, কিশোর কুমার। তাঁর গানে, মেজাজে, স্বভাবে ছিল হাসি, কষ্ট, প্রেম, উন্মাদনা—সবকিছু। কিন্তু এই অনবদ্য শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনে এমন এক মুহূর্ত এসেছিল যা তাঁকে ভেঙে দিয়েছিল অন্তর থেকে। সেই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮১ সালে, পুত্র অমিত কুমারের বিয়ের ঠিক দশ দিন আগে।

 উচ্ছ্বাস থেকে অশ্রুতে ভাঙা কিশোরের অজানা ঘটনা এই প্রথমবার ফাঁস করলেন অমিত কুমার। সম্প্রতি, দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অমিত কুমার জানান, ১৯৮১ সালে তাঁর বিয়ের সমস্ত প্রস্তুতি চূড়ান্ত ছিল। পাত্রী ছিলেন কলকাতার একজন পরিচিত পরিবারের মেয়ে। আয়োজনে ছিল বলিউডের সেরা তারকাদের আমন্ত্রণ, ছাপা হয়েছিল বিয়ের কার্ড পর্যন্ত। কিন্তু বিয়ের মাত্র দশ দিন আগে তাঁদের কানে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য—পাত্রীর আগেই একবার বিয়ে হয়েছিল!  এবং বলাই বাহুল্য তা ওঁর পরিবার আমাদের জানাননি। অমিত বলেন, "ওই মেয়েটির আগেই বিয়ে হয়েছিল, সেটা আমরা জানতেই পারিনি। সবকিছু তৈরি, কিন্তু হঠাৎ এমন একটা সত্যি সামনে চলে আসে।"

গোটা ব্যাপারটায় যারপরনাই ভেঙে পড়েছিলেন কিশোর। এই ঘটনাই যেন কিশোর কুমারের মনটা একেবারে গুঁড়িয়ে দেয়। অমিত জানান, তাঁর বাবা তখন বলেছিলেন—“তুই বিয়ে কর, নিজের জীবন গুছিয়ে নে। আমি বিয়ের পর খাণ্ডোয়ায় ফিরে যাব, আর সেখানেই শান্তিতে থাকব। তোমরা মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে এস।”

কিন্তু যখন সব কিছু হঠাৎ থেমে গেল, কিশোর কুমার যেন মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ২৪ জানুয়ারি, যেদিন অমিতের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, সেদিনই কিশোরবাবু জেদ করে কলকাতা উড়ে যান—নতুন পাত্রী খুঁজতে।

আর  সেই উড়ানের পরেই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন কিশোর! কলকাতা পৌঁছনোর পরই ঘটে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর কিছুক্ষণের মধ্যেই কিশোর কুমার পড়ে যান অসুস্থ। হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি, সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে।

এই প্রথম হৃদরোগই পরে হয়ে ওঠে তাঁর দীর্ঘ স্বাস্থ্যসংকটের সূচনা। অমিত বলেন, “এই মানসিক ধাক্কাটা ও সহ্য করতে পারেননি। সেই ঘটনার পর থেকেই বাবার শরীর আর আগের মতো ছিল না।”

 গানের মানুষ, কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক সংবেদনশীল পিতা ছিলেন এই কিংবদন্তি শিল্পী ।  কিশোর কুমার, যিনি মঞ্চে ছিলেন উদ্দাম, হাস্যরসিক এবং প্রাণোচ্ছল, ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ একজন পিতা।ছেলের জন্য তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার আঘাতই যেন ধীরে ধীরে তাঁকে ভেতর থেকে নিঃশেষ করে দিয়েছিল।

একটা অজানা গল্প—যা বলিউডের রঙিন পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ছিল এতদিন। কিশোর কুমারের গানে আমরা পেয়েছি হাজারো আবেগ, কিন্তু তাঁর নিজের জীবনেই ছিল এমন এক সুর, যা দুঃখে ভেজা, নিঃশব্দ, হৃদয়বিদারক।


প্রসঙ্গত, কিশোর কুমার নিজে কখনও মুম্বই বা বলিউডকে ‘নিজের’ বলে মনে করেননি। জীবনের এক অকপট সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, এই শহর তাঁর জন্য নয়। তিনি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন খণ্ডবায়, তাঁর পৈতৃক ভিটেতে। তবে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি—তার আগেই মৃত্যু হয় তাঁর।

 “এই বোকা, বন্ধুহীন শহরে কে বাঁচতে চায়? এখানে সবাই আপনাকে ঠকানোর জন্য মুখিয়ে থাকে। কাউকে কি ভরসা করা যায়? আমি এই অর্থহীন দৌড়ঝাঁপ থেকে বেরিয়ে খণ্ডবায় ফিরে যেতে চাই, আমার পিতৃপুরুষের মাটিতে। কে মরতে চায় এই কুৎসিত শহরে?”—এই কথাগুলো বলেছিলেন নিজে কিশোর কুমার এক সাক্ষাৎকারে।যদিও কিশোর কুমার অসাধারণ সব হিট কমেডি ছবিতে অভিনয় করেছেন, বাস্তবে তিনি অভিনেতা হতে চাননি কখনও। তিনি জানান,“আমাকে প্রতারণা করে অভিনয়ের জগতে আনা হয়েছিল। আমি শুধু গাইতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাই আশোক কুমারের সুবাদে ছবির দুনিয়ায় নামতে হল। পরিচালকদের তো আমার দরকার শুধু বিক্রির জন্য, আদর বা সম্মান নয়।”