তাঁর মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে ৩৮ বছর। তবু আজও তাঁর ম্যাজিক অটুট। তিনি, কিশোরকুমার। বেঁচে থাকলে শুক্রবার ৯৭ বছরে পা দিতেন কিশোরকুমার। তাঁর আজব কাণ্ড-কারখানার গল্প আজও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। তবে আমুদে এই মানুষটার অনমনীয় মনোভাব এবং প্রেমিক সত্বাও ছিল ততটাই প্রবল। ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত হয় কিশোর কুমারের একটি সাক্ষাৎকার। যা হইচই ফেলে দিয়েছিল পাঠকমহলে। সে সাক্ষাৎকারে কিশোর যেন জনপ্রিয় গায়ক নন, যেন ছিলেন এক দার্শনিক! কিশোর কুমার সোজাসাপটা মুখ খুলেছিলেন জীবনের প্রেম, ব্যর্থতা ও মৃত্যু নিয়ে—। 

 

সাক্ষাৎকারের সেটিংই ছিল চমকে দেওয়ার মতো— কিশোর কুমারের ঘরে ছিল একটি ‘লাল চোখওয়ালা খুলি’। সেটি নিয়েই রসিকতা করে কিশোর বলেন, “আমার চশমা পড়িয়ে দেখুন তো, কেমন লাগছে?” তারপর সামনে বসা সাংবাদিককে বলে ওঠেন, “তুমি একজন ভাল মানুষ। তুমি জীবনের আসল জিনিসগুলো বোঝো। তুমিও একদিন এরকমই দেখতে হবে।”

 

কিশোরের প্রথম স্ত্রী রুমা দেবী সম্পর্কে কিশোর বলেছিলেন, “উনি গুণী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু আমাদের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা ছিল। আমি চেয়েছিলাম একজন গৃহিণী, আর উনি চাইছিলেন কেরিয়ার। সংসার আর কেরিয়ার একসঙ্গে চলে না।”

 

এরপর আসে তাঁর মাধুবালার সঙ্গে বৈবাহিক জীবনের হৃদয়বিদারক বিবরণ - কিশোরের কথায়, “বিয়ের আগেই জানতাম ও মরবে। কিন্তু আমি কথা দিয়েছিলাম। ৯ বছর ধরে ওর মৃত্যু দেখেছি নিজের চোখে। ও হেসেছে, কেঁদেছে, চিৎকার করেছে— আমি শুধু পাশে থেকেছি, কারণ ডাক্তার বলেছিল হাসাতে হবে। আমি সেটাই করেছি ওর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত।” তৃতীয় স্ত্রী যোগিতা বালি সম্পর্কে কিশোর বলেন, “এটা একটা ঠাট্টা ছিল। ওর মনেই ছিল না সংসার করার। মা-আসক্ত ছিল।” তবে চতুর্থ স্ত্রী লীনা চন্দ্রভারকার নিয়ে ছিলেন সন্তুষ্ট - “ও একজন এমন মানুষ যে ট্র্যাজেডি দেখেছে। ও জানে জীবনের অস্থায়ীতা কী। আমি এখন সুখী।”

 

এককথায় এ যেন ছিল এক শিল্পীর আত্মদর্শন: এক যুগের সমাপ্তির সামনে দাঁড়ানো গায়ক। সেই সাক্ষাৎকারটি শুধু এক কিংবদন্তির ব্যক্তিজীবনের জানালা নয়, বরং সেই সময়ের সমাজ ও শিল্পজগতের প্রতিচ্ছবিও। আজ যখন কিশোর কুমারের মৃত্যুদিন বা জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানানো হয়, তখন এই একান্ত কথোপকথন মনে করিয়ে দেয়— ‘ইয়োডেলিং’-এ মজে থাকা কিশোর কুমার একজন গভীর আত্মবিশ্লেষী মানুষও ছিলেন।

 

 

কিশোর কুমারের গানে, মেজাজে, স্বভাবে ছিল হাসি, কষ্ট, প্রেম, উন্মাদনা—সবকিছু। কিন্তু এই অনবদ্য শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনে এমন এক মুহূর্ত এসেছিল যা তাঁকে ভেঙে দিয়েছিল অন্তর থেকে। সেই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮১ সালে, পুত্র অমিত কুমারের বিয়ের ঠিক দশ দিন আগে।

 উচ্ছ্বাস থেকে অশ্রুতে ভাঙা কিশোরের অজানা ঘটনা এই প্রথমবার ফাঁস করলেন অমিত কুমার। সম্প্রতি, দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অমিত কুমার জানান, ১৯৮১ সালে তাঁর বিয়ের সমস্ত প্রস্তুতি চূড়ান্ত ছিল। পাত্রী ছিলেন কলকাতার একজন পরিচিত পরিবারের মেয়ে। আয়োজনে ছিল বলিউডের সেরা তারকাদের আমন্ত্রণ, ছাপা হয়েছিল বিয়ের কার্ড পর্যন্ত। কিন্তু বিয়ের মাত্র দশ দিন আগে তাঁদের কানে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য—পাত্রীর আগেই একবার বিয়ে হয়েছিল!  এবং বলাই বাহুল্য তা ওঁর পরিবার আমাদের জানাননি। অমিত বলেন, "ওই মেয়েটির আগেই বিয়ে হয়েছিল, সেটা আমরা জানতেই পারিনি। সবকিছু তৈরি, কিন্তু হঠাৎ এমন একটা সত্যি সামনে চলে আসে।"

গোটা ব্যাপারটায় যারপরনাই ভেঙে পড়েছিলেন কিশোর। এই ঘটনাই যেন কিশোর কুমারের মনটা একেবারে গুঁড়িয়ে দেয়। অমিত জানান, তাঁর বাবা তখন বলেছিলেন—“তুই বিয়ে কর, নিজের জীবন গুছিয়ে নে। আমি বিয়ের পর খাণ্ডোয়ায় ফিরে যাব, আর সেখানেই শান্তিতে থাকব। তোমরা মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে এস।”