আজকাল ওয়েবডেস্ক: ওয়াশিংটনে মাঝরাতে হঠাৎ অন্ধকার নেমে এল—বিদ্যুৎ না থাকায় নয়, ঐক্যের অভাবে। মার্কিন কংগ্রেসে অস্থায়ী তহবিল বিল নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ায়, সরকার কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে। প্রায় ৮ লক্ষ ফেডারেল কর্মীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, থেমে গেছে বহু গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা। প্রথম দৃষ্টিতে এটি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অচলাবস্থা মনে হলেও, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির এই স্থবিরতা বিশ্ববাজারে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।


রিপাবলিকানরা একটি “ক্লিন” রেজোলিউশন চেয়েছিল—যাতে অতিরিক্ত নীতিগত পরিবর্তন ছাড়াই সরকার চলতে পারে। কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা দাবি তোলে স্বাস্থ্যবিমা তহবিল, বিশেষ করে Affordable Care Act ও Medicaid সহায়তা সংযুক্ত করতে হবে। দুই পক্ষই নতি স্বীকার করেনি, ফলে বিল ব্যর্থ হয়। এই অচলাবস্থা একটি ২৭ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির কর্মক্ষমতা স্তব্ধ করেছে, যার বার্ষিক ব্যয় প্রায় ৬.৫ ট্রিলিয়ন ডলার।


দূর ভারতে, দিল্লি ও মুম্বইয়ের নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতির ওপর গভীর নজর রাখছেন। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বৃহত্তম বিনিয়োগ উৎসগুলোর একটি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ পেয়েছে, যার বড় অংশই এসেছে আমেরিকা থেকে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কনীতি ভারতের রপ্তানিতে আগেই চাপ সৃষ্টি করেছিল। এখন সরকার বন্ধের কারণে আমেরিকান চাহিদা কমে গেলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে।

আরও পড়ুন: কেন চিকিৎসকদের হাতের লেখা খারাপ এবং কখনই ঠিক হওয়ার নয়


এই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, বস্ত্র ও ওষুধে ৫০% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে ভারতের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় বাজার থেকে প্রায় ২.৭ বিলিয়ন ডলার তুলে নিয়েছেন, বছরে মোট বহিঃপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে ১৭.৬ বিলিয়নে। টাকার মান পড়ে গেছে রেকর্ড নিম্নে—৮৮.৮ টাকায় প্রতি ডলার। পরিস্থিতি সামলাতে রিজার্ভ ব্যাংক বাজারে তরলতা বাড়ানো ও মুদ্রা হস্তক্ষেপের চিন্তায় রয়েছে।


এর প্রভাব শুধুমাত্র মুদ্রা বা শেয়ারবাজারে নয়। আইটি খাতের প্রকল্প বিলম্বিত হতে পারে, উৎপাদন ও ওষুধ রপ্তানি অর্ডারও পিছোচ্ছে। ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কর্মীরা ছুটিতে থাকায় বিমান পরিবহনেও প্রভাব পড়তে পারে। আমেরিকান ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ওপর নির্ভরশীল ভারতীয় স্টার্টআপগুলোর তহবিলও বিলম্বিত হতে পারে।


ট্রাম্প প্রশাসনের আগের মেয়াদেও ২০১৮-১৯ সালে ৩৫ দিনের দীর্ঘতম সরকার বন্ধ হয়েছিল। এবার পরিস্থিতি আরও জটিল, কারণ শুল্ক যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত এই অচলাবস্থা দ্বিগুণ চাপ সৃষ্টি করছে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর ওপর। বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিদিন সরকার বন্ধ থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি প্রায় ০.১৫ থেকে ০.২০ শতাংশ কমে যায়; দুই সপ্তাহে প্রায় অর্ধ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হতে পারে।


ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, নতুন শুল্কের কারণে এই অর্থবছরের প্রথমার্ধেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার কমেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির হার ১২% থেকে নেমে ৪%-এর নিচে নেমেছে। বস্ত্রখাত স্থবির, আর রত্ন-গয়নার রপ্তানি এক ত্রৈমাসিকে কমেছে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। তাই আমেরিকান চাহিদা কয়েক শতাংশ কমলেও ভারতের রপ্তানি ক্ষতি কয়েক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। আইটি ও পরিষেবা খাতও চাপের মুখে, বিশেষত কড়া H1B ভিসা নিয়মের কারণে।


সব মিলিয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বন্ধ ও নতুন শুল্কনীতি ভারতের জন্য একটি জটিল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। রপ্তানি ও মুদ্রা স্থিতি রক্ষা করতে এখন প্রয়োজন সূক্ষ্ম অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ—না হলে আমেরিকার এই ‘অন্ধকার রাত’-এর প্রতিধ্বনি ভারতের বাজারেও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।