আজকাল ওয়েবডেস্ক: উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে জনপ্রিয় ফাস্টফুড চেইন কেএফসি (KFC)-র একটি আউটলেটে হঠাৎ হামলা চালিয়ে সেটি বলপূর্বক বন্ধ করে দিলো হিন্দু রক্ষা দল নামের একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী। ঘটনাটি ঘটেছে দিল্লি সীমান্ত ঘেঁষা ইন্দিরাপুরম থানার কাছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, একদল মানুষ দোকানের ভেতরে ঢুকে হট্টগোল করছে, ‘হর হর মহাদেব’ ও ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানে দোকান কাঁপিয়ে তুলছে। দেখা যায়, দোকানের এক কর্মচারীর উদ্দেশে একজন চেঁচিয়ে বলছে, “এটা সাওনের মাস, এখানে নন-ভেজ বিক্রি করা যাবে না।” অন্য একজন বলে, “এটা শুধু এখানেই নয়—যেখানে যেখানে মাংস বিক্রি হয়, সাওনের মাসে তা পুরোপুরি বন্ধ হওয়া উচিত। প্রত্যেকের উচিত এই ধরণের বিক্রির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা।”

আরও পড়ুন: আসামে বেআইনি ‘পুশব্যাক’ নীতির বলি — বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে সীমান্তে ফেলে আসা বরপেটার দুই মুসলিম বৃদ্ধা

পুলিশের সামনেই দোকান বন্ধ

একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা গিয়েছে, পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও কেএফসি আউটলেটটি বন্ধ করে দেওয়া ঠেকাতে কোনও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি। পরে ওই গোষ্ঠী একইভাবে গাজিয়াবাদেরই একটি বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ‘নাজির’-এর সামনেও বিক্ষোভ দেখিয়ে, সেটির কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।

শ্রাবণ মাসে বারবার হামলার পুনরাবৃত্তি

শ্রাবণ মাস বা সাওনের সময় উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডে কাঁওয়ার যাত্রা উপলক্ষে বহুবার এই ধরনের ধর্মীয় হুমকি ও হামলা দেখা যায়। এই মাসটিকে শিব ভক্তদের জন্য পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য করা হয়, যেখানে অনেকে উপবাস রাখেন এবং মাংস ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু এই ব্যক্তিগত ধর্মাচরণকে এখন রাজনৈতিক হাতিয়ার করে ব্যবহার করছে কিছু চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী। গত বছরই উত্তরপ্রদেশ সরকার কাঁওয়ার যাত্রাপথে দোকানের নাম এবং মালিকদের ধর্ম চিহ্নিত করতে বলেছিল, যাতে ‘ক্রেতারা বুঝতে পারেন তারা কার থেকে কিনছেন।’ এমনকি ফল বিক্রেতা ও সাইকেল পাংচার দোকানেও ধর্মের ছাপ বসানোর চেষ্টা হয়।

‘হিন্দু ব্যাবসা বনাম মুসলিম ব্যাবসা’ বিভাজন?

এ বছরও দিল্লির এক মন্ত্রী বলেন, কাঁওয়ার যাত্রাপথে সমস্ত মাংসের দোকান বন্ধ থাকবে, কারণ অধিকাংশ ‘অবৈধ’। যদিও দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন জানায়, এ নিয়ে তারা কোনও অফিসিয়াল নির্দেশ জারি করেনি। কিন্তু ময়দানে বাস্তবটা আলাদা—লোকজন ভয়ে নিজে থেকেই দোকান বন্ধ করে দেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (VHP) ইতিমধ্যেই দিল্লির রেস্তোরাঁ এবং দোকানে গেরুয়া স্টিকার লাগাচ্ছে যেখানে লেখা— ‘গর্ব সে কহো হম হিন্দু হ্যায়’ ও ‘সনাতনী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান’। এটা স্পষ্টতই ব্যবসায়িক পরিসরে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা।

শুধু মাংস নয়—গো-রক্ষার নামে হত্যা, দলিত নিপীড়ন, কৃষকদের পিষে দেওয়া

এই ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং উত্তরপ্রদেশে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা এক সংগঠিত হিংসাত্মক প্রবণতার অংশ। অতীতে বহুবার গো-রক্ষার নামে মুসলিম যুবকদের প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারা হয়েছে। কখনও গরুর মাংস বহনের সন্দেহে, কখনও গরু চুরির গুজবে। প্রশাসন বহুক্ষেত্রেই নীরব থেকেছে, এমনকি অভিযুক্তদের রাজনৈতিক আশ্রয়ও দেওয়া হয়েছে। দলিত নারীদের উপর ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন এবং সামাজিক বয়কট—এই অপরাধগুলো বারবার ঘটেছে, কিন্তু ন্যায়বিচার অধরাই থেকে গেছে। ললিতপুর, হাথরাস কিংবা উন্নাও—প্রতিটি ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে যে দলিতদের জীবনের মূল্য এখানে খুবই কম। এমনকি কৃষকদের ক্ষেত্রেও একই নির্মমতা প্রযোজ্য। ২০২১ সালে লখিমপুর খেরিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলের গাড়ি আন্দোলনকারী কৃষকদের পিষে দেয়, সেই ঘটনায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে প্রশাসন দেরি করে। কৃষকরা বারবার বলেছে—এই রাজ্যে সংবেদনশীলতা নয়, আছে নিপীড়ন ও দম্ভ।

সাওনের নামে ধর্মীয় আবেগকে উস্কে দিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও খাদ্যাভ্যাসের অধিকারকে হরণ করার এ এক বিপজ্জনক প্রবণতা। এর পেছনে আছে এক গূঢ় রাজনৈতিক প্রকল্প—সংখ্যালঘু, দলিত, প্রান্তিকদের কোণঠাসা করে সংখ্যাগুরুর এক হিন্দু রাষ্ট্র কল্পনার বাস্তবায়ন। পুলিশ ও প্রশাসনের নীরব সম্মতি সেই লক্ষ্যে ইন্ধন জোগাচ্ছে। আজ মাংস বন্ধ, কাল হয়ত নাম, ভাষা, পোশাক—তখনও কি আমরা নীরব থাকব?