সমরেশ : এক অজানা বাউল

শতবর্ষ উত্তীর্ণ হলেন কালকূট। বিশ শতকের মূল্যবোধের দুনিয়াকে একটা নতুন সঙ্কেতে প্রতিস্থাপিত করবার কারিগরের নাম সমরেশ বসু। কালকূট মানেই এক মোহমুদগল থেকে মুক্তি-

 

 

সমরেশ বসুর মধ্যে চিরকাল এক অজানা বাউল বাস করে গিয়েছে। সে বাউল তার মনের একতারাতে সুর বেঁধেছে। সুর গেঁথেছে। আর সেই সুরকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছে  মর্ত্যলোকের আনাচে কানাচে। সে সুরে কখনও আত্মগরিমা নেই। সে সুরে কখনও আত্মপ্রচার নেই। আছে বাউলের সাধনতত্ত্বের মূল কথা; এই মানুষে  সেই মানুষের সন্ধান।           

 

 

সমরেশের এই সাধক জীবন তাঁর অজানা অচেনা বহু পরিচয়ে মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যের ভান্ডারে, বিশেষ করে কালকূট ছদ্মনামে লেখা তাঁর কালজয়ী সৃষ্টিগুলির মধ্যে সেই বিস্তার আমরা দেখি। সমরেশের যে সাধনা, সেটা কিন্তু প্রথাগত কোনও  আধ্যাত্মিক সাধনা ছিল না। কোনও  প্রাতিষ্ঠানিক দেব-দেবতা ঘিরে কখনও কোনও রকম আকর্ষণ বোধ করেছেন সমরেশ  তাঁর সৃষ্টিতেএমনটা আমরা কখনও দেখিনি। 

 

 

'কোথায় পাবো তারে' উপন্যাসের মধ্যে অদ্ভুত এক ব্যঞ্জনায় ধরা পড়েছে বাংলা, ঝাড়খন্ড, তখনকার বিহার সীমান্তবর্তী গ্রাম মুলুটির কথা। সেই মুলটি গ্রামে দীপান্বিতা অমাবস্যার দিন কালীপুজোকে ঘিরে এক অসাধারণ প্রান্তিক সংস্কৃতির কথা আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন কলকূট নামের আড়ালে। সেই প্রান্তিক সংস্কৃতির মধ্যে যত না প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি আকর্ষণ বিচ্ছুরিত হয়েছে, তার থেকে হাজারগুণ বেশি মানুষের ধর্মের নানা আনুষঙ্গিকতাকে ঘিরে স্থি  হয়েছে এক অজানা জগতের কথা। অচেনা দুনিয়ার কথা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির মধ্যে যৌন চেতনা ঘিরেও যে অজানা দুনিয়া এই উপন্যাসে সমরেশ লিখেছেন, সেখানে কোনওরকম ভালগারিটির আশ্রয় না নিয়ে, তাকে তুলে ধরা -এই যে মুনশিয়ানার পরিচয় কালকূট রেখে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে দিয়েই জীবনবাউল সমরেশের অন্তরের বাউল সত্তাটি বারবার প্রকাশিত হয়েছে। সমরেশ কিন্তু তাঁর বাউল সত্তা দেখানোর জন্য কখনও ভেক ধরেননি। কখনও আলখাল্লা পড়েননি। হাতে একতারা নেননি। কপালে তিলক কেটে তাঁকে  একবারের জন্যেও সখের বাউল সাজতে  হয়নি। নিজের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা বাউল সত্তাটির ক্যানভাসিং করবার জন্য সমরেশ কিন্তু শহুরে যে  পোশাকে  নিজের জীবনটা কাটাতে ভালবাসতেন, তেমনটাই চিরকাল থেকেছেন। সেভাবেই কিন্তু তিনি তাঁর নিজের পরিব্রাজক জীবনের যাপনপথ বুকে অতিবাহিত করেছিলেন।

 

 

আজকাল দেখতে পাওয়া যায় এই বহিরঙ্গের বাউলেপনাকে দেখাতে অনেকের ভিতরেই। নানা ধরনের ভেক ধরবার এক অদ্ভুত অনুসঙ্গ। সেই অনুষঙ্গের মধ্যে আসে না বাউলের সাততালির খিলকা। এসে যায় নানা ধরনের শহুরে পোশাকের রংবেরঙের বৈচিত্র। আবার ঝুঁটিবিহীন বাউলের বহিরঙ্গ  দেখবার দেখানোর জন্য রংবেরঙের রুমাল দিয়ে মাথা ঢাকবার এক অদ্ভুত কৌশল। ঝুঁটি হল বাউল জীবনের একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুসঙ্গ। মৌলবাদীরা বেসরা মনে করে বাউলদের ঝুঁটি কেটে নিয়ে, তাঁদের উপরে অত্যাচার চালায়।

               

 

এই বহিরঙ্গের বাউলেপনাকে কালকুট কিন্তু ঘৃণা করতেন। যে কোনও ধরনের দেখনদারিকেই  কিন্তু কালকূট  ঘৃণা করতেন। তাই কখনও তাঁর সৃষ্টির দুনিয়াতে নিজের রাজনৈতিক বোধকেও  এতোটুকু প্রচারধর্মী আঙ্গিকে তিনি তুলে আনেননি। অথচ রাজনৈতিক বোধের সার্বিক প্রকাশের মধ্যে দিয়েই সৃষ্টির ভুবনকে তিনি নির্মাণ করেছিলেন। আবার চরিত্রগুলির নানা ধরনের সামাজিক ওঠাপড়ার মধ্যেও এক অদ্ভুত ধরনের মানবিক স্ফুরণ আমরা দেখতে পাই। সেই স্ফুরণের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আবর্তিত হয়েছে রাজনৈতিক বোধের যে প্রধান স্তম্ভ, শ্রেণী সচেতনতা যাতে সমরেশের ছিল পরিপূর্ণ বিশ্বাস, তার সুস্পষ্ট  প্রয়োগ।

                             

 

নিজের  সৃষ্টিতে মানুষ দেবতার সন্ধানে যে পরিক্রমা, সে পরিক্রমা তাঁর জীবন পাঠকে ঋদ্ধ করেছে। করেছে পাঠককে মুগ্ধ। ঠিক তেমনি তাঁর প্রয়াণের  এতকাল পরেও মুগ্ধ করে চলেছে এবং আরও বহু সন্ধ্যা বাঙালির তুলসী মঞ্চে, দহলিজে প্রদীপ হয়ে সেই সৃষ্টির আলো জ্বলতেই থাকবে। মাঝি, এই খেয়াপারের মাঝিকে সমরেশ দেখার চোখ দিয়ে বহুভাবে দেখেছেন। শোনার কান দিয়ে বহুভাবে তাকে শুনেছেন। আর হৃদয় দিয়ে তাকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করেছেন।

 

 

রবীন্দ্র সৃষ্টিতে যেমন মানব জন্ম তরীর মাঝিকে বারবার নানা ভঙ্গিমায় আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং মানব জীবনের সুদূর পরাহত অস্তিত্বকে প্রবাহিত করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই মাঝিকে একটা বিশেষ ধরনের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, যেন ঠিক সেভাবেই সমরেশ তাঁর সৃষ্টির নানা গহীন অন্তরে, মাঝিকে একটা বিশেষ স্থানে রেখে, গোটা বিষয়টিকে পরিচালিত করবার চেষ্টা করেছেন।

 

 

তাঁর 'গঙ্গাউপন্যাসে ধীবর জীবন সংক্রান্ত যে আখ্যান, সেখানেও কিন্তু ধীবর যাপনের সঙ্গে এই যে মাঝি জীবনের একটা সম্পর্কঅর্থাৎ যে ব্যক্তি সময় বা স্রোত পথ একটা আঙ্গিক থেকে আর একটা আঙ্গিকের দিকে জীবনকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেই বয়ে চলা জীবনের জয়গানের মধ্যে দিয়ে, মানুষের চিন্তা চেতনার জগতের এক ক্রমপ্রসারিত আঙ্গিক, তাকে কে সমরেশ চিরদিন দুহাত তুলে আহ্বান করে গেছেন। কালকূট শিরোনামে  তিনি 'কোথায় পাব তারে' লিখছেন। এই গ্রন্থের প্রায় শুরুর পর্যায়ে সমরেশের কলম থেকে নিঃসৃত হচ্ছেমাঝির দিকে তাকিয়ে এমনি মনে হয় তার জগৎজোড়া দরজা বন্ধ।

                 

 

মাঝিযিনি জগৎ পারবার পার করবেন, তার জগৎজোড়া দরজা বন্ধ -এই শব্দটা পড়লে কারও কারও মধ্যে একটা প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দিতে পারে। ভারতীয় মিথলজির একটি আঙ্গিকে মৃত্যুর পরে বৈতরণী  পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে এই মাঝির উল্লেখ বিশেষভাবে একটা বড় অংশের মানুষের কাছে পরিচিত। আমাদের প্রাচীন বৈষ্ণব শাস্ত্রেও রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিরহ সমস্ত পর্যায়ে ঘিরেই মাঝি মানেই হচ্ছে একটা মুক্তির স্বাদ। মাঝি মানেই হচ্ছে একটা মুক্ত হওয়া। যে মাঝি স্থান থেকে স্থানান্তরে নিয়ে গিয়ে মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্নার যাপন চিত্রে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

             

 

 

সেই পরিবর্তন কখনও মানুষের কাছে ইতিবাচক হয়। আবার কখনও  সেই পরিবর্তনের ঘটনাস্রোত মানুষের জীবন যাপন, সমস্ত কিছুকে একটা দুঃখের আবর্তে এনে ফেলে দেয়। তাহলে কেন মাঝির জগৎজোড়া দরজা বন্ধ - এমন একটি ভাবনার কথা কালকূট বলছেন -এ প্রশ্ন পাঠকের মনে ওঠা খুব স্বাভাবিক। যিনি দরজা খোলবার মালিক, তার কেন দরজা বন্ধ

 

 

আসলে আমাদের প্রচলিত ধ্যান ধারণায় যখন আঘাত, দুঃখ, বেদনা ইত্যাদি জাগতিক বিষয়গুলি খুব বেশিভাবে ক্রিয়াশীল থাকে, তখন কি ভাববাদের একটা বিশেষ রকমের দ্রুত পথের নিগড়ে মানুষ বাঁধা পড়ে যায়? মানুষ তখন ভাবতে থাকে আঘাত যিনি দিচ্ছেন, আঘাত তিনিই সইবেন। আঘাত থেকে তিনিই উত্তরিত করবেন বা দুঃখ যিনি দিচ্ছেন, বেদনা যিনি  দিচ্ছেন, তিনিই সেই বেদনা সিক্ততার অশ্রু বিন্দু থেকে আমাদের আনন্দ উচ্ছ্বাসের এক অনুকল্পনীয় জগতে উত্তোরিত করে দেবেন।

 

 

এই যে মাঝিকে ঘিরে এক ধরনের ভাববাদী উচ্চারণ আমাদের যাপন চিত্রের সঙ্গে প্রায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, এই উপন্যাসের শুরুতেই কালকূট যেন সেই চেতনার আরোহীনিতে একটা জোরদার আঘাত আনছেন। ভাববাদ বনাম বস্তুবাদের যে চিরকালীন দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বের পরিসরকে মাঝির জীবনের পরিসরের ওঠাপড়ার নিরিখে এইভাবে ব্যাখ্যা করা, এমন বস্তুবাদী- সমাজতাত্ত্বিক দ্যোতনা ভারতীয় দর্শনের চার্বাকপন্থীদের উচ্চারণের মধ্যে আমরা বহুবার শুনেছি। কিন্তু সেই উচ্চারণ আমাদের জীবনের বাস্তবতার ক্ষেত্রে আত্মস্থ করবার মতো জায়গা খুঁজে পাওয়ার বদলে  থেকে যায় বহু রকমের দ্বিধাদ্বন্দ্ব। অনেক ক্ষেত্রে সংকীর্ণতাও কাজ করে। সেই সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে একজন পরিচালকের, একজন সারথীর চলবার পথের সংকেতের এ হেন উচ্চারণ আমাদের এক বিস্ময়ের সমুদ্রে এনে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

  • গৌতম রায়