উমার বিদায়

সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর দুর্গা, উমা দাশগুপ্ত, বাঙালির মনে গেঁথে যাওয়া এক চরিত্র। বাঙালির স্মৃতিপটে সেই অভিনয় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে-

 

 

উমা দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' র দুর্গা চলে গেলেন। এই দুর্গার সঙ্গে নিজের জীবনকে মিলিয়ে দেখেনি বা দেখবে না ভবিষৎতে, এমন বাঙালি ছেলে-মেয়ে বুঝি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ যে ছেলে বা মেয়ে বিনোদনের, আরাম-আয়েসের চরম সীমাতে থাকে, সেও তার ভাই-বোনের খুনসুটির মধ্যে ভালবাসার সংজ্ঞা খুঁজতে আশ্রয় নেবে অপু-দুর্গার।

               

 

বাঙালির আইকন হয়ে আছে, থাকবে এই অপু-দুর্গা। সময় বদলেছে। আরও বদলাবে। প্রেক্ষিতেও আসবে অনেক ওলোটপালট। কিন্তু ভাই-বোনের সম্পর্কের এই রসায়ন কখনও বদলাবে না। ভাই বা বোন, পরিণত বয়সে অনেক কারণ থেকে তাদের মধ্যে যদি সম্পর্কে একটা দূরত্বও তৈরি হয়, তবে ভাই, কখনও একটু বৃষ্টি ভেজা রাতে, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে কি একবারও মনে করবে না, জীবনে প্রথম সিগারেট খাওয়ার পর বাড়ি ঢুকে কেউ যাতে গন্ধ না পায় সেজন্যে, বোন বা দিদিই তাকে জুগিয়ে দিত ঠাকুমার পানের ডাবর থেকে মৌড়ি বা চ্যবন বাহার অথবা ছোট এলাচ। আর একথা মনে হলে, সেই ভাই বা দাদার চোখটা একটু কড়কড় কি করে উঠবে না?

 

 

সম্পর্কের পারদের চড়াই-উৎড়াইতে বোন বা দিদি, পৈতৃক সম্পত্তি নিক্তিতে ভাগ করে নিয়েছেন ভাই বা দাদার কাছ থেকে। এই কাজ করতে গিয়ে সম্পর্কটা হয়তো এমনই হয়ে গেছে যে, আর হয়তো সেভাবে ভাই-বোনে দেখা সাক্ষাৎই হবে না। পাওয়ার মধ্যেই জেগে আছে একটা বিষন্নতা। অর্থ প্রাপ্তি, ভাই-বোনে বাবার স্থাবর-অস্থাবর নিয়ে, মায়ের গয়নাগাটি নিয়ে, সেই প্রাপ্তি আর যাই হোক কখনও তো মনের ভাঁড়ারকে প্রাপ্তির সুখ দিতে পারে না। সেই পাওয়া আর না পাওয়ার ভালোমন্দ, হর্ষ-বিষাদের মধ্যেই বোন বা দিদির যখন মনে পড়বে ছোটবেলার কোনও খুনসুটির কথা, ইচ্ছে করে ঝগড়া করবার কথা, মান-অভিমানের কথা, ঠিক তখনই তার মনে পড়ে যাবে সিনেমার অপু আর দুর্গাকে।

 

 

অপু আর দুর্গা ঠিক এভাবেই বাঙালির মনের সঙ্গে, হৃদয়বত্তার সঙ্গে একেবারে মিলেমিশে রয়েছে। বাঙালি যতদিন থাকবে, হৃদয়ের এই টান ততদিন চিরজাগরুক থাকবে। আসলে শৈশব-কৈশোর মানুষের জাগরুক চেতনার এক অঙ্গাঙ্গী অংশ। সময়ের বিবর্তনেও সেই চেতনার মধ্যে কখনও কোনওরকম দাগ পড়ে না। সম্পর্কের টানাপোড়েন, সেটাও তো সময় নির্ভর। সম্পর্কের উপরে সময় একটা বড় রকমের দাগ ফেলে। তাতে অতীতের সম্পর্কের  ধারাবাহিকতা সবসময় বহমান থাকে না।

 

 

আবার বহু ক্ষেত্রে সেই বহমান সম্পর্ক আরও নিবিড়, আরও একাত্ম হয়ে ওঠে। এই টানাপোড়নের বিনি সুতোতেই তো জীবন চলছে। দুনিয়া চলছে। জগত চলছে। এই চলার নামই তো জীবন। আর জীবনের নামই তো চলা। সেই চলার ছন্দটা কোথায় যেন পথের পাঁচালীর অপু দুর্গার বেঁচে থাকবার লড়াই, সে লড়াইয়ের মধ্যে একদম মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। উমা দাশগুপ্ত তাঁর এক পরিচিত বৃত্তে একবার বলেছিলেন; পথের পাঁচালীতে একটি দৃশ্যায়ন আমরা দেখতে পাই চিনিবাস নামক যে মিষ্টি ফেরিওয়ালা ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে মিষ্টি ফেরি করছে। ঘন্টা বাজিয়ে তার মিষ্টি ফেরি করা আর অপু দুর্গার লোভাতুরভাবে সেই চিনিবাসের পেছনে পেছনে দৌড়ানো। অপু-দুর্গা, তাদের পেছনে একটি কুকুর আসছে। এই দৃশ্যটির দৃশ্যায়নের কথা উমা নিজেই  বলেছিলেন। শুটিংয়ে যে কুকুরটি ব্যবহার করা হয়েছিল সেটি কারও পোষা কুকুর ছিল না। রাস্তার কুকুর। তাহলে সেই কুকুরটি কীভাবে চিনিবাসের পেছনে দৌড়লো? অপু দুর্গার সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল

 

 

সাধারণ দর্শক ছবিটিকে দেখে হয়তো ধরে নিয়েছিলেন যে কুকুরটি শুটিং টিমের কারও পোষা বা স্থানীয় কোনও মানুষের পোষা। কিন্তু যখন আমরা সেই কুকুরটি সম্পর্কে উমা দাশগুপ্তর সাক্ষাৎকার পেলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে, না কুকুরটি কারও পোষা কুকুর ছিল না। আর দশটা রাস্তা কুকুরের মতনই সেটি ছিল। তাহলে সেই কুকুরটির অপু-দুর্গার পেছনে ওরকম লোভাতুর দৃষ্টিতে ছুটে যাওয়া রহস্যটা কী? উমা দাশগুপ্ত নিজেই সেই রহস্য ভেঙে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কুকুরটিকে ছুটোনোর কৌশল হিসেবে সত্যজিৎ রায় তাঁদের দুজনের হাতেই, অর্থাৎ; অপু এবং দুর্গা দুজনের হাতেই কিছু খাবার দিয়েছিলেন। সম্ভবত মিষ্টি। আর সেই মিষ্টিটার লোভেই কুকুরটি অপু-দুর্গার পেছনে পেছন ওভাবে ছুটে আসছিল যেটা আমরা ফিল্মে দেখতে পাই।

                     

 

এই দৃশ্যায়নের মধ্যে আমরা অনেকেই হয়তো নিজেদের শৈশবকে খুঁজে পাই। বিশেষ করে যারা বিশ্বায়ন পূর্ববর্তী সময়কালে বড় হয়েছি। কলকাতা শহরে বড় হয়েছি বা মফস্বল শহরে বড় হয়েছি। যেখানে বিশ্বায়িত পৃথিবীর আজকের নানা ধরনের নিত্যনতুন কৌশল ছিল না। শৈশবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার এই যে ফেরিওয়ালার ডাক, যে ফেরিওয়ালার ডাকের কথা রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তাঁর এক অনবদ্য বইয়ের মধ্যে খোদাই করে রেখে গেছেন। সেই ফেরিওয়ালার ডাকের মধ্যে দিয়ে যে শৈশবকে ছুঁয়ে যাওয়ার ব্যঞ্জনা, তা আজও আমরা অনুভব করতে পারি। শহরে আজকে মফস্বল শহরে বা গ্রামে অনেক সময় এই ফেরিওয়ালার ডাক শুনতে পাওয়া যায়। আজকের ফেরিওয়ালার ডাকের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও অনেকরকম ফের এসেছে। সেই রকম ফের ঘিরে সমাজ মাধ্যমে নানা ধরনের আলাপ আলোচনা হয়। সেই আলাপ আলোচনা জের ধরে ফেরিওয়ালার ডাকের মধ্যেও একটা নতুন ধরনের জায়গা আমরা দেখতে পাই।

 

 

সম্প্রতি এক বাদাম বিক্রেতার বাদাম ফিরি  করার গান ঘিরে সমাজ মাধ্যমে যে ধরনের আলাপ আলোচনা হয়েছে, আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে যেন কোথাও একটা সেই অপু দুর্গার সময়কালের চিনিবাসের ঘন্টার আওয়াজ আমাদের কানে একটু হলেও বেজেছে। আসলে সময় বদলায়। বিপণনের পদ্ধতি বদলায়। কিন্তু বিষয়টা তো একই থাকে। মানুষকে আকৃষ্ট করে নিজের সামগ্রীকে কী করে বাজারজাত করতে পারা যায়, সেটাই। সেই লক্ষ্যে বড় বড় বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের বিপণনের নিত্য নতুন কৌশল আবিষ্কার করে। সেই কৌশল আবিষ্কারের পেছনে থাকে বহু মেধাসম্পন্ন মানুষদের ফসল থাকে। বহু টাকার বিনিয়োগ থাকে।

           

 

চিনিবাসের মতো মানুষরা, যাদের উত্তরসুরি আজকের বাদাম বিক্রেতা, তাদের বিনিয়োগের মধ্যে থাকে কেবলমাত্র ভালোবাসা। বিনিয়োগের মধ্যে থাকে শুধুমাত্র তাদের ভাঁড়ারের জিনিসের স্বাদ, গন্ধ ইত্যাদির বৈশিষ্ট্য। এই যে চিনিবাসের ঘন্টা যা অপু-দুর্গার কাছে একটা হ্যামলিনের বাঁশির মতো মনে হতো, এমন  বাঁশির ডাক  তো আমরা সবাই পেয়েছি শোনপাপড়িওয়ালা থেকে, আইসক্রিমওয়ালা থেকে, নানা ধরনের মিঠাইওয়ালার কাছে। আজও সেইসব ফেরিওয়ালার ডাক আমাদের কানে বাজে। আবার অনেক ফেরিওয়ালা সমাজ জীবনের নানা বিবর্তন আধুনিকতার পরশে আস্তে আস্তে তাদের পেশার জগতটাকে অদল বদল করে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। যাদের মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় দা-বঁটিতে ধার দেওয়া, কুয়োর বালতি তোলা, শীলকোটানো এরকম অনেক কিছু।

 

 

উনিশ শতকের সূচনা পর্ব ঘিরে কেরী সাহেবের মুন্সি, প্রমথনাথ বিশীর লেখা বা বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলাম বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময়, এইসব কালজয়ী উপন্যাসগুলির মধ্যে কলকাতার শহরের বা  শহরতলীর  সেইসময়ের এমন অনেক হ্যামলিনের বাশির খোঁজ পাওয়া যেত। পথের পাঁচালী অপু দুর্গা যেন আমাদের সেই হ্যান্ডলিনের বাঁশি। উমা দাশগুপ্তর প্রয়াণ যেন সেই বাঁশিওয়ালার হারিয়ে যাওয়া। আমাদের শৈশবের গ্রন্থিমোচনের এক বুকফাটা হাহাকার। উমা দাশগুপ্তরা নশ্বর জীবন ত্যাগ করলেও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকেন। উমা দাশগুপ্ত মাত্র একটি ফিল্মে অভিনয় করেছেন। এই একটি ফিল্মের মধ্যে দিয়ে দর্শকের মনে চিরকালের জন্য গেঁথে যাওয়া -এটা কিন্তু কম কথা নয়। 

  • গৌতম রায়