যুক্তি বনাম অন্ধত্ব

সামাজিক হতাশাই মানুষকে চিরদিন যুক্তিহীন করে দেয়।ঠেলে দেয় কুসংস্কারে।সেখান থেকে উত্তোরিত হওয়ার চেষ্টাই এখন আমাদের অন্যতম বড় কর্তব্য-

 

 

সমাজমাধ্যম খুললে মাঝে মাঝে একটু শঙ্কিত হয়ে পড়তে হয়।সংশয় জাগে ঠিক মতো সমাজমাধ্যম ই খুললাম তো? নাকি কোনো ধর্মীয় বিষয়ের বিজ্ঞাপন খুলে বসলাম শেষ পর্যন্ত? বেশিরভাগ রিল দেখতে দেখতেই মূর্ত হয়েছে উঠছে কোনও না কোনও দেব দেবতার ছবি।আনুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে তাদের চোখের পাতা পড়ছে। তারপরেই ঠোঁট নড়ছে। সেই দেবতা বলছেন, ওই রিল বা ভিডিওতে লাইক দিয়ে তার জয়গান কমেন্টেসে করতে। তারপর তিন জন হোক, সাত জন হোক, সেই দেবতা নির্ধারিত সংখ্যায় সেটিকে শেয়ার করতে। শেয়ার করলেই, যিনি এটা করবেন, তার ভাগ্য খুলে যাবে। আর যদি কেউ অবজ্ঞা করে এড়িয়ে যান, তার ক্ষতিরও বিস্তারিত বিবরণ প্রযুক্তির সাহায্যে সেই দেবতার মুখ দিয়ে করা হচ্ছে।

 


ধর্ম আর ধর্মান্ধতার ধন্দে কেমন যেন গোলমাল লেগে যায়। আমাদের দেশে প্রতিটি মানুষের ধর্ম পালন করবার অধিকার আছে। আবার কেউ যদি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী না হন, তাঁর সেই নিজের বিশ্বাস নিয়েই সেই মানুষটির মেতে থাকবার অধিকার আছে। ভারতের মহান সংবিধান প্রত্যেকটি দেশবাসীকে তার নিজের নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস বা বিশ্বাসহীনতার প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে জীবন যাপন করবার অধিকার দিয়েছে।

 


ভারতীয় সংবিধান কখনও কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখায়নি। আবার কখনও কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি বৈরিতা ও প্রকাশ করেনি। ভারতীয় সংবিধানের এই অনন্য সাধারণ মর্মবাণী স্বাধীনতার এত বছর পরেও নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক -সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ববিরোধ সত্ত্বেও প্রবাহমান ভারতের যে মূল স্পিরিট, তাকে অসাধারণ ভাবে ধারণ করে চলেছে। এই ধারণ ক্ষমতা দেশবাসীর মধ্যে যাতে প্রবাহিত হয়, বিদ্যমান থাকে সেই প্রভাব, তার জন্য ভারতের সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং যে সমস্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাঁরা কাজ করে চলেছেন।

 

 

ধর্মান্ধতাকে ভারতবাসীর মনে দেগে দেওয়ার একটা রাজনৈতিক উপক্রম হিসেবে ব্রিটিশের স্বার্থসিদ্ধি করতে বিকশিত হয় আধুনিক ভারতে। উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে অখন্ড ভারতের বুকে জোরদারভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এই প্রয়াস। অখন্ড ভারতে যেমন একটা অংশের হিন্দুদের মধ্যে তৈরি হয় এই প্রবণতা আর তার জেরে ঠিক তেমনটাই একটা বড় অংশের মুসলমানদের মধ্যেও তৈরি হয় একই প্রবণতা।
জাতীয়তাবাদ পরিণত হয় হিন্দু জাতীয়তাবাদে। আর সেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের ফলশ্রুতি হিসেবে তৈরি হয় মুসলিম জাতীয়তাবাদ। দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশভাগের পরেও ধর্মের নামে দাঙ্গা, জাতপাতের নামে দাঙ্গা, এই রক্তাক্ত পথ বেয়েই আজও কিন্তু ভারত টিকে আছে। ভারতবাসী টিকে আছে।

 

ধর্মঘিরে আবেগ, যারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করেন, তাদের প্রত্যেকের মধ্যে  আছে। কিন্তু সেই আবেগকে যখন ব্যবহার করা হয় রাজনীতির স্বার্থে বা ব্যবসার স্বার্থে, তখনই সেটা হয়ে ওঠে সবথেকে বেশি আপত্তিজনক। এই বিষয়টাকে সমাজমাধ্যমে ভিডিওর ভেতর দিয়ে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটাকে একটা ভিন্ন পথে ব্যবহার করবার প্রবণতা শুরু হয়েছে।
             

 

এটার মূল উদ্দেশ্য কী?  প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ঘিরে যে সমস্ত গ্রন্থাদি আছে বা যে সমস্ত ব্যক্তিত্বদের মধ্যকালীন ভারত থেকে উনিশ শতকের নবজাগরণের পর্যায়ে যে সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, যার পুরোধা ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের মত ব্যক্তিত্ব, স্বামী বিবেকানন্দ সেই চেতনাকে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বিশেষভাবে পরিচিত করেছিলেন। যে পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে নয়, সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে, ধর্মান্ধতার পথে নয়, ধর্মীয় চিন্তা চেতনার পথে, ভারতবাসীর মুখ উজ্জ্বল হয়েছিল।
               

 

সেই চেতনাকে রাজনৈতিক অর্থে ব্যবহার করবার তাগিদে এই যে সার্বিক উপক্রম, সেই উপক্রমের মধ্যে দিয়ে সহজ সরল ভারতবাসী, যাঁদের একটা বড় অংশের প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ সেভাবে ঘটেনি, সেই সমস্ত মানুষদের কাছে যখন এভাবে কোনও দেবতার মূর্তি বা ছবি, সেগুলিকে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এই পর্যায়ের মধ্যে পর্যবসিত করা হয়, সেখানে আদৌ কি ধর্মের কোনও স্থান থাকতে পারে?
মানুষের ধর্ম বিষয়ক আকর্ষণ, তাকে যখন ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক স্বার্থে ,ব্যক্তি স্বার্থে বা ব্যবসায়িক স্বার্থে, তার থেকে অন্যায় বোধহয় আর কিছু হতে পারে। যে কোনও মানুষ, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করেন, ধর্মের তাত্ত্বিক ভিত্তির  খুব গভীরে প্রবেশ না করে, এই অংশের মানুষের অনেকের মধ্যেই নানা বিষয় নিয়ে একটা দুর্বলতা তৈরি হয়। কেউ নিজে অসুখ বিসুখে ভুগছেন বা আত্মীয় পরিজন অসুখ-বিসুখে ভুগছেন। কারও সন্তান চাকরি পাচ্ছে না বা অন্য কোনও ধরনের পারিবারিক অশান্তিতে জড়িয়ে আছেন। মামলা মোকদ্দমা জড়িয়ে আছেন। তাছাড়াও কোনও না কোনও সামাজিক সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে আছেন। এই ধরনের মানুষের একটা বড় অংশ, তাঁদের মধ্যে ধর্মঘিরে দুর্বলতা এমন একটা জায়গায় অনেক সময় পৌছে যায়, যার সুযোগ এই ধর্মব্যবসায়ীরা নিতে কসুর করে না।

 

 

ধর্ম মেনে চলা মানুষেরাও অনেক সময় কোন ধরনের ব্যক্তি পরিবার বা সামাজিক বিপদে পড়লে ধর্মের প্রতি আস্থা রেখে ভুলে যান সাধারণ যুক্তিবাদ। এই যুক্তিবাদের মধ্যে কিন্তু কোনও নাস্তিকতা নেই। এ যুক্তিবাদের মধ্যে যে বিষয়গুলি আছে তা হল, কোনও দেব দেবতাই আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এটা কাউকে বলতে পারেন না যে, আমার এই বক্তব্যটা তুমি এতজন মানুষকে শেয়ার করো। তাহলে তোমার এই সাফল্য ঘটবে বা কমেন্ট বক্সে আমাকে ঘিরে ভালো কথা লেখ। তাহলে তোমার কাছে এই এই সুযোগ সহজে ধরা দেবে। আর যদি এইসব তুমি না করো, তাহলে তোমার এই এই বিপদ ঘটবে।
               

 

আসলে চিরদিন একটা অংশের ধর্ম ব্যবসায়ী মানুষের সাধারণ বিশ্বাস, দেবতার প্রতি ভক্তি ইত্যাদিকে ব্যবহার করে দৈবশক্তি সম্পর্কে একটা ভয় মানুষের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছে। সেই ভয়ের দরুন সাধারণ মানুষ বহু ক্ষেত্রে এই ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর প্রচার ঘিরে একটা গভীর সংশয়ের মধ্যে বসবাস করতে শুরু করেছেন। আর সেই সংশয়ের ভেতর দিয়েই তৈরি হচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর রকমের আত্মদুর্বলতা। মানুষ হারিয়ে ফেলছেন নিজের প্রতি বিশ্বাস। 
               

 

এই নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার জায়গা থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের অন্ধত্ব। ধর্মান্ধতা। এগুলির প্রতি আকর্ষণে সাধারণ মানুষ বহু ক্ষেত্রেই ধর্ম আর ধর্মান্ধতার মধ্যে ফারাক করতে পারেন না। ফলে, ধর্মান্ধতাকেই তাঁরা অনেক সময় ধর্ম বলে ঠাওর করে বসেন। আর সেই ধর্মান্ধতাকে ধর্ম বলে বিশ্বাস করে বসার জায়গা থেকে শুরু হয় নানা ধরনের সমস্যা। সেই সমস্যা কখনো আসে ব্যক্তি জীবনে আবার কখনো সেই সমস্যা প্রতিবিম্বিত হয় ব্যক্তি থেকে সমাজে। আর সেই সমাজের সমস্যা গ্রাস করে দেশের নানা ঘটনাক্রমের অন্তরকে।
সমাজমাধ্যম খুললেই দশটা বিজ্ঞাপনের মধ্যে অন্তত চারটে থাকে জ্যোতির ঘিরে বিজ্ঞাপন। এইসব বিজ্ঞাপনে যেভাবে দর্শককে প্রভাবিত করবার চেষ্টা করা হয়, সেই চেষ্টার মধ্যে দিয়ে আর যাই হোক সাধারণ মানুষের মনের বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষকে সেখানে নানাভাবে প্রভাবিত করবার চেষ্টা হয়। সে প্রভাব কিন্তু সবসময়ই একটা নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে করা হয়। কোনও রাশির অটুট সাফল্যের কথা বলা হয়। নতুবা কোনও রাশির চরক বিপদের কথা বলা হয়।
               

 

যেভাবে এই ধরনের বিজ্ঞাপনগুলি মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়, তার আকর্ষণ সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ এড়িয়ে যেতে পারে না। তারা বিশেষভাবে আকর্ষিত হয় নিজেদের জীবনের ভবিষ্যৎ জানবার তাগিদে। আর সেই তাগিদ থেকেই তৈরি হয় অদ্ভুত এক ধরনের মানসিক হতাশা।  যে রাশিকে ঘিরে প্রচুর ইতিবাচক কথা বলা হলো, সেই রাশির মানুষেরা যখন দেখলেন, ওই ইতিবাচক কথার সঙ্গে বাস্তবতার কোনও মিল নেই। তখন তাঁদের মধ্যে নেমে আসে এক ধরনের হতাশা। আবার যে রাশির মানুষেরা প্রথমেই জেনে গেলেন তাঁদের জীবনের সংকটের কথা। তাদের মধ্যেও সেই প্রথম থেকেই শুরু হয়ে যায় এক ধরনের হতাশা, বিষাদ, অবসন্নতা। ইতিবাচক, নেতিবাচক সব ধরনের প্রচারের মধ্যে দিয়েই সাধারণ মানুষের মনোবলকে ভেঙে দিয়ে, এভাবে তাঁদের বিভ্রান্ত করা, এটা স্পষ্টত একটা সামাজিক অপরাধ।
           

 

ইন্টারনেট ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এই সামাজিক অপরাধ এখন এমনভাবে আমাদের গোটা সমাজদেহে ছড়িয়ে পড়েছে যাকে এক কথায় সামাজিক ক্যান্সার বললে মনে হয় না খুব একটা ভুল বলা হবে। অতি সাধারণ মানুষ হয়তো দুবেলা পেট ভরে খেতেও পান না। তাঁরাও এইসব জ্যোতিষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নানা ধরনের গ্রহরত্ন, তাবিজ- কবজ ইত্যাদি কুসংস্কারের আবর্তে পড়ে একেবারে সর্বস্ফান্ত হয়ে যাচ্ছেন। কখনও কখনও আমরা দেখতে পেয়েছি, সামাজিকভাবে অত্যন্ত খ্যাতিসম্পন্ন মানুষজন, সমাজে যাঁদের একটা প্রভাব আছে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্তরের মানুষ, তাঁরা এই ধরনের জ্যোতিষের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করছেন। গ্রহরত্নের প্রোমোশনের সঙ্গে নিজেদেরকে সংযুক্ত করছেন। এই ধরনের বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ঘিরে প্রয়াত এক বিশিষ্ট অভিনেতার কার্যকলাপ নিয়ে এক কালে যথেষ্ট সমালোচনা পর্যন্ত হয়েছে।

  • গৌতম রায়