অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়: চুনী গোস্বামী যেমন ফুটবল থেকে ক্রিকেটে এসেছিলেন, বাহাত্তরে পড়ে আমিও আধুনিক গান থেকে খেয়ালে এসেছি। বললেন বাংলা আধুনিক গানের মোড়–ফেরানো গানওয়ালা কবীর সুমন, যাঁর বাংলা খেয়ালের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হতে চলেছে আগামী শনিবার। এখন তিনি ৭২ ঠিকই, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাংলা খেয়াল সৃষ্টি করে চলেছেন কবীর সুমন। নবীন প্রজন্মের কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়মিত বাংলা খেয়ালে তালিমও নিচ্ছেন তাঁর কাছে। আগে শুধুই বাংলা খেয়ালের অনুষ্ঠানও করেছেন। কিন্তু এই প্রথম বাংলা খেয়ালের একটি পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম প্রকাশিত হতে চলেছে, যা কবীর সুমনের সৃষ্টি। যার বাংলা বন্দিশ রচনা করে গেয়েছেন তিনি। যাঁরা মনে করেন, বাংলায় খেয়াল হয় না, তাঁদের ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে প্রকাশিত হচ্ছে কবীর সুমনের অ্যালবাম ‘বাংলা খেয়াল’।
ভাবনা রেকর্ডস অ্যান্ড ক্যাসেটস প্রকাশ করছে এই অ্যালবাম। শনিবার বিড়লা আকাদেমিতে এই অ্যালবাম প্রকাশ হওয়ার কথা। এবং এখানে বাংলা খেয়াল গাওয়ার কথা কবীর সুমনের। কিন্তু এখন করোনার জন্যে এই অনুষ্ঠান কি হবে? ‘ভাবনা’–র কর্ণধার বিশ্ব রায় জানালেন, বিড়লা আকাদেমির প্রেক্ষাগৃহ ছোট। কম–বেশি দু’শো জন মানুষ বসতে পারেন। তাই অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। বিশ্ববাবু জানালেন, বিড়লা আকাদেমি থেকেও এই অনুষ্ঠান স্থগিত রাখতে বলা হয়নি।
কবীর সুমনের ‘বাংলা খেয়াল’–এর অ্যালবাম তৈরি। ভাবনা–র কর্ণধার বললেন, এই প্রথম বাংলা খেয়ালের পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম প্রকাশিত হচ্ছে, যা কবীর সুমনের সৃষ্টি। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কবীর সুমন বললেন, খেয়ালে কথার যদি কোনও গুরুত্বই না থাকে, তাহলে টেবিল, চেয়ার, খাট, আলমারির মতো কথা দিয়ে খেয়াল গাইলে কে ঠেকাবে? শাশুড়ি–ননদের গঞ্জনা, রাধাকৃষ্ণের লীলা, দই ভাগ করা নিয়ে নানান রাগে খেয়াল গেয়ে গেছেন হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের শিল্পীরা এবং এখনও গাইছেন। কিন্তু বাংলা আধুনিক গানে যদি ভাব ও ভাষা দিয়ে গান বাঁধা যায়, তেমন লিরিক দিয়ে কেন খেয়ালের বন্দিশ রচনা করা যাবে না? যায় যে, তারই প্রমাণ কবীর সুমনের বাংলা খেয়াল। এই অ্যালবামেরই ধানী রাগের খেয়ালের বন্দিশে কবীর সুমন লিখেছেন— ‘ছড়িয়ে গেছি কাছে দূরে/ ভবঘুরে/ দুনিয়া জুড়ে।/ আমি মানুষ, তুমি মানুষ, তারা মানুষ/ কথায় সুরে।/ কেউ কালো কেউ সাদা/ তবু একই সুরে বাঁধা।’ শুনলে, মন বলে ওঠে— আহা!
কবীর সুমন বললেন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপরে সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়।’ এটা যেমন আধুনিক বাংলা গানে সত্য, বাংলা খেয়ালেও সত্য। তাই বাংলা আধুনিক গানে নতুন দিশা দিয়েছেন যিনি, সেই কবীর সুমন বাংলা খেয়ালের বন্দিশেও নতুন আলো জ্বালাচ্ছেন।
সেই ১৭ বছর বয়সে আকাশবাণীর রাগপ্রধান আর ভজন গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন তিনি। বললেন, সেই ছোটবেলা থেকে কালীপদ দাসের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছি। অন্য গুরুদের কাছেও শিক্ষা পেয়েছেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন সারাজীবন। তবুও, দ্বিধাহীন সুমন বলছেন, ‘আমার অর্জিত শিক্ষা, আমার কল্পনা, আমার ক্ষমতা এবং অক্ষমতা দিয়েই বাংলা খেয়াল রচনা করেছি এবং গেয়েছি। আমার গাওয়ার ত্রুটি থাকতে পারে, আমার শিক্ষায় ত্রুটি নেই।’
‘বাংলা খেয়াল’ অ্যালবামে ‘পটদীপ’ এবং ‘ধানী’ রাগে খেয়াল গেয়েছেন তিনি। ছোট খেয়াল নয়। বিলম্বিত থেকে দ্রুতলয়, খেয়ালের সমূহ আঙ্গিক নিয়ে, সুর–তাল–ছন্দের সমন্বয়ে, তাঁর অতুলনীয় লিরিক আশ্রিত কবীর সুমনের এই অ্যালবাম— ‘বাংলা খেয়াল’। সন্দেহ নেই, বাংলা গানের শ্রোতারা আবার উচ্চারণ করবেন— তোমাকে চাই।