দীপেন্দু চৌধুরী: শুরুটা এরকম ধ্রুপদী পর্যায়ে উঠতে পারে প্রেক্ষাগৃহের দর্শক–শ্রোতারা কেউ বুঝেও উঠতে পারেননি। কারণ, আমরা গিয়েছিলাম সঙ্গীত–বিষয়ক একটি বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে। গত ২৭ এপ্রিল। অভিজাত জি ডি বিড়লা প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চের পর্দা তখনও ওঠেনি। বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ কানে ভেসে আসছে। তবলা বাজছে। বাজছে সানাইয়ের নিচু মাত্রার সূক্ষ্ম তান। সানাইশিল্পী আহমেদ আব্বাস খান সানাইয়ের সুরের মূর্ছনায় আবিষ্ট করে রাখলেন। সঙ্গে সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তবলায় সঙ্গত করলেন সমান উচ্চতায়। ধ্রুপদী সঙ্গীত বিষয়ক একটি বইয়ের প্রকাশ–অনুষ্ঠানের পরম্পরা এবং মর্যাদা রেখেই উদ্যোক্তারা এমন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। এদিনে মঞ্চে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ওয়াজের আলি শাহের চতুর্থ প্রজন্ম আহমেদ আব্বাস খানের পুত্র মাস্টার বাফর আব্বাস খান। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে সঙ্গ দিল সে। পরের অনুষ্ঠান বেহালা। বাজালেন সাকেত সাহু। এবং সেতার বাজালেন কল্যাণ মজুমদার।
বইটির নাম ‘আলাপ’। বইটির ধ্রুপদী মানের কথা মাথায় রেখেই এমন উদ্বোধন অনুষ্ঠান। ৬৪ জন ধ্রুপদী ঘরানার শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়ে বইটি লিখেছেন সেতারশিল্পী শুভজিৎ মজুমদার। প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং।
প্রকাশকেরা দাবি করছেন, আলাপ কেবলমাত্র একটি গ্রন্থ নয়। এটি বাংলার মার্গসঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গীত–উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ। তাঁদের সঙ্গীত চেতনার অভিব্যক্তি। সেতারশিল্পী শুভজিৎ মজুমদার ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ত্রিধারা কণ্ঠসঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত এবং তালবাদ্যের ত্রিবেণীকে উপজীব্য করে দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে বাংলার প্রথিতযশা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীদের হৃদ্মাঝারে ডুব দিয়ে সংগ্রহ করেছেন, তাঁদের হীরক কণাসম অমূল্য কথা, নিপুণ আলিম্পনে সেগুলি সাজিয়েছেন লেখক। পাঠক–পাঠিকাদের জন মার্গসঙ্গীতের ইতিহাসে এটাই প্রথম আকরগ্রন্থ। দাবি লেখক এবং প্রকাশন কর্তৃপক্ষের।
৬৪ জন শাস্ত্রীয় শিল্পীর মধ্যে আছেন ১৪ জন খ্যাতনামা ধ্রুপদী ঘরানার কন্ঠশিল্পী, ২০ জন তবলাশিল্পী এবং ৩০ জন যন্ত্রশিল্পীর সুখ–দুঃখ, আনন্দ–বেদনা, উত্থান–পতনের কথা। লেখক তুলে এনেছেন ৬৬৪ পৃষ্ঠার বইয়ে। বইটি লিখতে সময় নিয়েছেন চার বছর। বইটিকে বলা হচ্ছে ‘আলোক শীর্ষক সঙ্গীত সঙ্কলন’। এই বইয়ে ১২ জন নতুন শিল্পীর নাতিদীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। বইটি প্রকাশের সময় এল প্রত্যাশিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মঞ্চে এলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার অন্যতম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষক এবং শিল্পী পণ্ডিত অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ‘ঋজুদা’ ওরফে বুদ্ধদেব গুহ, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ–সহ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একাধিক শিল্পী, তবলাবাদক, যন্ত্রশিল্পী মিলিয়ে বিভিন্ন ধারার প্রায় ৩০ জন শিল্পীকে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়। একটি বিরল মুহূর্ত। অবিস্মরণীয় ঘটনা। মঞ্চে ছিলেন দে’জ পাবলিশিংয়ের কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে এবং প্রকাশনের তৃতীয় প্রজন্ম শুভঙ্কর দে। ‘আলাপ’–এর প্রকাশের পরে পণ্ডিত অমিয়রঞ্জন বলেন, ‘যে কাজটি করেছেন শুভজিৎ, তিনি অসাধ্যসাধন করেছেন। এইখানে থেমে গেলে চলবে না। আরও অনেক শিল্পী আছেন। তাঁদের খুঁজে বের করতে হবে।’ বুদ্ধদেব গুহ বলেন, ‘সব শিল্পীর কথা বলতে পারলে ভাল হত। মালবিকাদি, কাননবালা–সহ অন্যদেরও সংযোজন করা হোক।’ শুভঙ্কর দে বলেন, ‘এই বইটা আমাদের প্রকাশনীর সঙ্গীত–বিষয়ক তালিকায় আরও একটি সংযোজন।’ লেখক শুভজিৎ মজুমদারের দাবি, ‘বইটার নাম ‘আলাপ’ রেখেছি কারণ, রাগসঙ্গীতে আলাপচারিতা করেছি। সাঙ্গীতিক তাত্ত্বিক দিক ধরতে চেষ্টা করেছি এই বইয়ে। এটা একটা সাক্ষাৎকারের সঙ্কলন। এই ধরনের সঙ্কলন আগে কখনও হয়নি।’ পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘স্কেলটা অনেক বড়। এই কাজ আমাদের খুব কাজে লাগবে। এর আগে বাংলা ভাষায় এত বড় কাজ হয়েছে কিনা আমি জানি না। এই বইয়ে সঙ্গীত জগতের বড় মূল্য আছে। শুভজিৎ আমার সেন্ট জেভিয়ার্সের সহপাঠী। দীর্ঘদিন যত্ন নিয়ে পরিশ্রম করে এই কাজ করেছে ও।’ ■