রাজর্ষি সেন: গল্পটা আজকের সময়ের। কিন্তু চরিত্রগুলোর নাম পুরান-আশ্রিত। তাই উমা নেমে আসছে সমতলে, সুইৎজারল্যান্ড থেকে এই কলকাতায়। সঙ্গে তার বাবা হিমাদ্রি। উমার মা মেনকা সেই ছোটবেলায় ছেড়ে চলে গেছে তাকে। উমা গুরুতর অসুস্থ। তার জীবনসীমার একটা সম্ভাব্য সময়ও ‘ঘোষণা’ করে দিয়েছেন ডাক্তার। কিন্তু বিদেশে থেকেও কলকাতার দুর্গাপুজোর গল্প বাবার মুখে শুনে, স্বপ্নেও বোধহয় সেই পুজোর আওয়াজ শুনতে পায় উমা। সে দেখতে চায় কলকাতার পুজো। মেয়ের ‘শেষ ইচ্ছে’ পূরণ করতে বাবা হিমাদ্রি তাই কলকাতায় আসে। উদ্দেশ্য একটা ‘নকল’ অকালবোধন করা। যার ব্যবস্থা নানা হুজ্জোত করে পাকা করে ফেলেছে হিমাদ্রি। নকল দুর্গাপুজো, এই ভরা গরমে।
এই ছবিতে অন্য বিদেশি সিনেমার ছায়া আছে কিনা, সেটা বড় কথা নয়। কানাডার সাত বছরের ছেলে ইভানের ঘটনায় যে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘উমা’ তৈরি করেছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়, এটা ঘোষণা করেছেন তিনি। উল্লেখও করেছেন এছবির শেষে ইভানের ছবি সহ। ইভানের জন্য আসল বড়দিনের আগেই, অক্টোবরে বড়দিন নামিয়ে আনা হয়েছিল কানাডার সেন্ট জর্জে। ইভান মারা যাওয়ার আগে দেখে গিয়েছিল এই ‘নকল’ বড়দিন, যা আসল বড়দিনের থেকে একটুও কম ছিলনা। সেই ইভানের মা এসেছিলেন বাংলা ছবি ‘উমা’র মুক্তি উপলক্ষ্যে। এভাবেই মিলে গেল কানাডার ইভানের সঙ্গে কলকাতার উমা।
উমাকে কলকাতায় পুজো দেখাতে নিয়ে আসার আগেই নকল পুজোর বন্দোবস্ত করতে এসেছিল হিমাদ্রি। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে কীভাবে সম্ভব হল এমন একটা অকাল দুর্গাপুজো তৈরি করা, সেটাই ছবির মূল বিষয়। এবং তাকে কেন্দ্র করে উঠে আসে হিমাদ্রির জীবন, উঠে আসে পরিচালক ব্রহ্মানন্দের অতীতও।
প্রোডাকশন ম্যানেজার গোবিন্দর উদ্যোগে এবং পরিচালক ব্রহ্মানন্দের শিল্প-দৃষ্টিতে তৈরি হয় দুর্গাপুজোর পরিমণ্ডল। এসব করতে গিয়ে নানান ঝড়-ঝাপ্টা, বাধা-বিপত্তি পেরতে হয়। উঠে আসে নানান চরিত্র। এই ধর্ম না-মানা পুজোর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় মহীতোষ সুর। শব্দানুষঙ্গে স্পষ্ট, সে আসলে মহিষাসুর।
সৃজিত গভীর অনুভব থেকে তৈরি করেছেন ‘উমা’। কোথাও যদি যুক্তির খামতি থাকে সেটা ঢেকে যায় চরিত্রগুলির নামকরণ থেকে। উমা, হিমাদ্রি, মেনকা, মহীতোষ...।
আসলে একটা রূপকথা শোনাতে চেয়েছেন সৃজিত। আর, পরিচালকের কাজ হল গল্প বলা। যদি একজনও ঠিকঠাক শোনে সেই গল্প, তাহলেই সার্থক সেই প্রচেষ্টা। বললেন ব্রহ্মানন্দের গুরু, অসুস্থ বৃদ্ধ পরিচালক, এই ছবিতেই। মনোজ মিত্র অনবদ্য ওই একটি দৃশ্যেই।
এই ছবিতে উমার ভূমিকায় যিশু সেনগুপ্তর কন্যা সারা। তার চোখদুটো মায়ামাখা। ক্যামেরার সামনে সারা অভিনয় করছে বলে মনেই হয়নি, এতটা সাবলীল সে। রুদ্রনীল ঘোষ, অঞ্জন দত্ত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য খুবই সুন্দর। যিশুকেও ভাল লাগে। উমার ‘নকল’ মা শ্রাবন্তী আর পরিচালক ব্রহ্মানন্দের ছেড়ে যাওয়া স্ত্রীর ভূমিকায় গার্গী রায়চৌধুরি ভাল অভিনয় করেছেন। ভাল অভিনয় করেছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং বাবুল সুপ্রিয়ও।
সব মিলিয়ে এক ইচ্ছাপূরণের গল্প ‘উমা’। এক স্বপ্নপূরণের কাহিনী। ‘উমা’ মন ভাল করে দেয়। অনুপম রায়ের গান সেই মন ভাল করে দেওয়ার সাথী।