সম্রাট মুখোপাধ্যায়: ‘স্পাই মুভি’। পুরনো ছক। কিন্তু সেই ছকেই নতুন দানের ঘুঁটি ফেলেছেন পরিচালক মেঘনা গুলজার। নিজের পরিচালিত সিনেমা ‘রাজি’তে।
বুঝিয়ে দিয়েছেন সিনেমায় গুপ্তচরের রাজনীতি মানেই জেমস বন্ডকে ‘লাইসেন্স টু কিল’ দিয়ে দেওয়া নয়। সলমান খানের দেশি ‘টাইগার’ত্ব–ও নয়। এই চালু ফর্মুলার ‘ম্যাচো’ ব্যাপার–স্যাপারে ঢুকতেই রাজি নন মেঘনা। বরং তিনি এই ‘স্পাই’ ঘরানার এক নারীবাদী অনুবাদ বানাতে চান পর্দায়। আর তা বানিয়েছেনও সফলভাবে।
এই কাজে তাঁর অবলম্বন দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এক, ১৯৭১–এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আর তাতে ভারতের প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়া। দুই, ওই লড়াই চলার সময়েই এক ভারতীয় গুপ্তচরের এক পাক সেনা অফিসারকে বিয়ে করার ঘটনা। এই নিয়েই মেঘনার ছবি।
যে–ছবিতে তাঁর প্রধান দুই সহায় হল ওই গুপ্তচরের (সিনেমায় যার নাম সেহমত) চরিত্রে আলিয়া ভাটের দুরন্ত উপস্থিতি। আলিয়া তাঁর ‘প্রেজেন্স’কে (এই ছবির ৯৫ শতাংশ ফ্রেমেই তিনি) এই ছবিতে অভিনয় দক্ষতার মিশেলে যে চূড়ান্ত মাত্রায় নিয়ে গেছেন, তা প্রশংসনীয়।
এই ছবির দ্বিতীয় বড় উপাদান মূল কাহিনী। হরিন্দার সিক্কার লেখা জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কলিং সেহমত’ অবলম্বনে চিত্রনাট্য লিখেছেন স্বয়ং মেঘনা গুলজার আর ভবানী আইয়ার। সেই ভবানী, যিনি একসময় সঞ্জয় লীলা বনশালির জন্য ‘ব্ল্যাক’ কিংবা ‘গুজারিশ’–এর মতো চিত্রনাট্য লিখেছে। উপন্যাসের আলো–ছায়া, খাঁজখোঁজগুলো সিনেমাতে ভারী চমৎকারভাবে চেনা গেছে। নিছক ‘স্পাই মুভিজ’–এর ‘মারো আর দৌড়োও’ মার্কা চেনা একঘেয়েমিটা কেটে গেছে। বরং তার জায়গা নিয়েছে অনেকটা অন্দরমহল, জেনানা–মহল আর পারিবারিক সম্পর্কের কাটাকুটি খেলা। অন্দরমহল— যেন রাষ্ট্রের ভেতর লুকিয়ে রাখা অন্য এক রাষ্ট্র।
আর এই মজার ‘সিনেম্যাটিক’ খেলাটা মেঘনা খেলেছেন কিন্তু রাষ্ট্রের লুকোনো নানা রাজনীতির মুখকে উন্মোচন করতে। ছবির শুরু থেকে দ্বিতীয়ার্ধের মাঝখান পর্যন্ত চিত্রনাট্যকে, সংলাপ ভাবনাকে, এমনকী ছবির গান–ব্যবহারের (সুর শঙ্কর এহসান লয়ের) মেজাজকেও জড়িয়ে থাকে হালকা একটা জাতীয়তাবাদ। খুব উগ্র ‘টোন’–এ না হলেও, বোঝা যায় দেশকে ভালবেসে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছে–ভাললাগা ইত্যাদিকে বিসর্জন দেওয়ার মহিমান্বিত এক গল্প শোনাচ্ছে এই চিত্রনাট্য। যেখানে সেহমত নামের এক কাশ্মীরি মেয়ে বিয়ে করছে ইকবাল সইদ নামের এক তরুণ পাক অফিসারকে (ভিকি কৌশল) এবং থাকতে আসছে পাকিস্তানের এক ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। সেহমতের বাবা হিদায়েত (রজিত কাপুর) ছিল আসলে এক ভারতীয় গুপ্তচর। ক্যান্সারে মৃত্যু আসন্ন জেনে কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে এল নিজের শূন্যস্থান পূরণে। বিশেষ স্পাই ট্রেনিং–এর ব্যবস্থা করল বন্ধু তথা ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার অন্যতম শীর্ষকর্তা খালিদ মিরের (জয়দীপ আহলাওয়াট, যাঁর অভিনয় এই ছবির আরেক বড় আকর্ষণ) সহায়তায়। পাকিস্তানের ব্যাপারে খবর পাওয়ায় হিদায়েতের ‘টার্গেট’ ছিল বন্ধু পাক ব্রিগেডিয়ার পারভেজ সইদ (শিশির শর্মা)। বলাই বাহুল্য, পারভেজ জানে না যে বন্ধু হিদায়েত আদতে ভারতীয় গুপ্তচর। তাই বন্ধুকে মৃত্যুপথযাত্রী জেনে তার মেয়ের সঙ্গে নিজের ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করে পারভেজ।
এখানেই এই ছবি আলাদা আর পাঁচটা ‘স্পাই’ ছবির থেকে তো বটেই, এমনকী বলিউডের পাক–ভারত সম্পর্ক বা লড়াই কেন্দ্রিক অন্য ছবির থেকে। এই ছবিতে এমন এক পাক সেনা পরিবারকে আমরা দেখি, যে পরিবার সৈনিকের দায়িত্বে ভারতের সঙ্গে প্রবলভাবে লড়ছে, ডিনার টেবিলে সেই লড়াই নিয়ে টুকরো–টাকরা আত্মগর্বী মন্তব্যও আসছে, কিন্তু কখনই অন্ধ ভারত–বিদ্বেষে ভুগছে না। ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় সঙ্কীর্ণতায় কিংবা হিংস্রতায় ভুগছে না। বরং তাদের বিশ্বাসকে ব্যবহার করেই পাকিস্তানে বসে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এক ভারতীয় এজেন্ট। এবং তাকে ঘিরে আরও একরাশ গুপ্তচরও। নানারকম ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে। ভারতীয় গুপ্তচর–বাহিনীর এমন ‘নেটওয়ার্ক’–এর স্বীকারোক্তি এই দেশের ছবিতে খুব একটা আমরা দেখিনি। বরং দেশের মাটি ব্যবহার করে আইএসআই কার্যক্রম দেখতেই হিন্দি ছবির দর্শক অভ্যস্ত।
আবার এখানেই ছবি শেষ নয়। এর থেকেও ভয়ঙ্করতর উপলব্ধি আছে ছবির শেষ অংশে। যেখানে পৌঁছে সেহমত বুঝতে পারে, আসলে রাষ্ট্রের হাতে সে এক যন্ত্র বিশেষ। দেশের জন্য ভালবাসা, জাতীয়তাবোধ— এ সব আবেগের বিশেষ দাম নেই সেই ‘সিস্টেম’টার কাছে। যে ‘সিস্টেম’টা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে আর সেই যুদ্ধে ‘যন্ত্র’ বা ‘টোপ’ কিংবা ‘ঘুঁটি’ হওয়া ছাড়া সেহমতদের আর অধিকতর কোনও নিয়তি নেই! এই জায়গায় পৌঁছে বোঝা যায়, কেন ছবির শুরুতে আর শেষে গল্পকে ছুঁয়ে যায় কাশ্মীরের ভূখণ্ড। দুই রাষ্ট্রের অনন্ত টানাপোড়েনে বিক্ষত এক আত্মা। সেহমত। কাশ্মীর। বাবা গুলজার পাঞ্জাব নিয়ে বানিয়েছিলেন ‘মাচিস’। দু’দশক পরে মেয়ে মেঘনা গুলজার কাশ্মীর নিয়ে বানালেন ‘রাজি’। সেই বারুদ আর চোখের জলকে পাশাপাশি রেখে।
অনেকদিন পরে বড় পর্দায় পাওয়া গেল সোনি রাজদানকে। পর্দাতেও তিনি সেহমতের মানে আলিয়ার মা। ছোট্ট চরিত্র। তবু তিনি স্বমহিমায়। আর দুই বাঙালি প্রোডাকশন ডিজাইনার সুব্রত চক্রবর্তী ও অমিত রায় পাকিস্তানের অন্দরমহলের প্রায় অর্ধশতক আগের চেহারা যে ‘ডিটেলিংস’–এ তুলে ধরেছেন, তা চোখ ভরিয়ে দেয়।