সম্রাট মুখোপাধ্যায়:
● জলে জঙ্গলে, পরিচালনা: নীতীশ রায়, অভিনয়ে: মিঠুন চক্রবর্তী, জ্যাকি শ্রফ, আশিস বিদ্যার্থী, টিনু আনন্দ, মমতাজ সরকার, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, রজত গঙ্গোপাধ্যায়।
দু’রকম হরর ফিল্মকে মিশিয়েছেন নীতীশ রায়। জঙ্গল–ফিল্মের ছদ্মবেশে। আটের দশকের বলিউড। আর নয়ের দশকের হলিউড মিলে আছে সেখানে। মিলটা হচ্ছে কোনও একটা ভয়ংকর স্থান থাকবে লোকচক্ষুর আড়ালে, আর সেখানে দল বেঁধে বেড়াতে যাবে একদল ছেলেমেয়ে। তারপর বিপদে পড়বে, ফর্মুলা মেনে, অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে মূর্তিমান আতঙ্ক।
আটের দশকের বলিউডে সেটা ছিল রামসে ব্রাদার্স–এর ভুতুড়ে হানাবাড়ি, নয়ের হলিউডে সমুদ্রপারে চলে আসা গডজিলা বা জঙ্গলের অ্যানাকোন্ডা। নীতীশ রায়ের ‘জলে–জঙ্গলে’–তে অবশ্য ভূত বা ড্রাগন বা সাপ কোনওটাই নয়, বরং এসেছে কুমীরের আতঙ্ক। যে সে কুমীর নয়, একেবারে একশোফুট লম্বা এক কুমীর! যাকে ‘জেনেটিকাল–মিউটেশান’ করে তৈরি করেছে এক ক্ষ্যাপাটে বৈজ্ঞানিক আর্যনীল মুখোপাধ্যায় (মিঠুন চক্রবর্তী।) আর্যনীল ২০ বছরের গবেষণায় তৈরি করেছে এই কুমীর। যে চেহারায় ভয়ঙ্কর হলেও চরিত্রে শান্ত, তবে তাকে কেউ ক্ষেপিয়ে তুললে মুশকিল, ইত্যাদি আর কী, মানে যেমনটা ফর্মুলায় হয়। এই কুমিরটি প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরদের উত্তরসুরী যেন! জঙ্গলের খাড়িতে এক গোপন স্থানে নিজের এই সৃষ্টিকে রচনা এবং লালন পালন করে চলেছেন আর্যনীল। আর এরই ভেতর ঢুকে পড়ে দু’টো আলাদা–আলাদা দল, একটা দল জঙ্গলে ফুর্তি করতে আসা একদল কলেজ পড়ুয়ার, আর অন্য দলের নেতৃত্বে আছে তিন শিকারী। যারা ঐ কুমীরকে শিকার করতে এসেছে। এদের একজন ভারতীয় ( আশিস বিদ্যার্থী), একজন আফ্রিকান, একজন মেমসাহেব। আর এদের সঙ্গে জুড়ে আছে এক স্থানীয় দালাল (দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য)। এদের পাঠিয়েছে এক চিড়িয়াখানা–মালিক। প্রথম পক্ষের বঁাধন ছেড়া হৈ–চৈ আর দ্বিতীয় পক্ষের সাজিয়ে রাখা টোপে উত্তেজিত হয় কুমীর। ধাওয়া করে দু–পক্ষকেই। এরপর সাজানো ছক—সামনে শিকার, পেছনে কুমীর, তার পেছনে শিকারী দল, আর সবার পেছনে বিজ্ঞানী আর্যনীল। ব্যাপারটা যতটা উত্তেজক হওয়া উচিত ছিল ততটা হয়নি দু–তিনটে কারণে। এক, দু–পক্ষের এই ছুটোছুটির ব্যাপারটার মধ্যে যে ‘ক্রিশ–ক্রশ’ খেলাটা আছে, সেটা এ ছবিতে ততটা জমে নি। দুই, আতঙ্কটা জমতে না জমতেই দুম করে ‘ক্লাইম্যাক্স’ টা চলে এল দু’ দুবার, ফলে গা–ছমছমে মজাটা বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিন, সর্বোপরি বাজেটের অভাবটা বোঝা গেছে। এ’ধরনের অ্যাডভেঞ্চার ফিল্ম যে ‘ভিএফএক্স’ দাবি করে, যতগুলো ক্যামেরা দাবি করে, যে মানের ‘স্টাট’ দাবি করে তার কোনওটাই মেলেনি। বরং রাতের অন্ধকার দিয়ে যেন আড়াল করতে চাওয়া হয়েছে এসব অভাব। ছবির শুরুতে বাঘ আর কুমীরের যে লড়াই, সেটা তো ভালো করে বোঝাই গেল না। এই ইন্টারনেট আর ‘ন্যাট জিও’–র যুগে এ’দিয়ে বাচ্চাদের আকর্ষণ করা কঠিন। তবে একটা কথা, এ’ছবি ছোটদের জন্য বানিয়েছেন নীতীশ। বানিয়ে থাকলে, মদ আর যৌনতার এত বাড়াবাড়ি কেন? মিঠুন চক্রবর্তী বা আশিস বিদ্যার্থীর মতো অভিনেতারা কেবল মাত্র ‘বিহেভ’ করে গেছেন। মিঠুনের উইগটাও কিম্ভূত হয়েছে। চিড়িয়াখানার মালিক আর সারো–এর চরিত্রে জ্যাকি শ্রফ কিংবা টিনু আনন্দ তো অপচয়। একমাত্র ’এ রকম একটা অন্যপথে চেষ্টার জন্যই নীতীশবাবু প্রশংসা পেতে পারেন। ‘ইয়েতি’, আমাজন’, ‘যখের ধন’–এর পরে ‘জলে জঙ্গলে’। বাংলা ছবি অভিযানের সাহস এবং ভূগোল বাড়াচ্ছে।